সাইফুল হক মোল্লা দুলু, কিশোরগঞ্জ ।।
পদ থাকলেও চিকিৎসক নেই। আবার কাগজে-কলমে চিকিৎসক থাকলেও প্রতি মাসে বেতন-ভাতা তুলে কাজ করছেন অন্য হাসপাতালে। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এমন পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। হাওরে যেতে চিকিৎসকদের অনাগ্রহের সীমা নেই। ফলে ভেঙে পড়েছে এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাওরে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৬৮টি। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে ৩১টি। কর্মরত আছেন ৩৭ জন। বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে কিশোরগঞ্জ টিআইবি’র সচেতন নাগরিক কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক এমএ কাইয়ুম বলেন, এ থেকেই বোঝা যায় কিশোরগঞ্জের গভীর হাওরে কার্যত সরকারি চিকিৎসা সেবা বলতে কিছু নেই। ফলে হাওরের বিশাল জনগোষ্ঠী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরেজমিন জানা গেছে, গভীর হাওরের ইটনা, নিকলী, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন উপজেলায় ৩৭ জন চিকিৎসক কর্মরত। এর মধ্যে মিঠামইনে ১৬ জন চিকিৎসকের মধ্যে আছেন ৮ জন; নিকলীতে ১৭ জনের মধ্যে ৭; অষ্টগ্রামে ১৬ জনের মধ্যে ১১ এবং ইটনা উপজেলায় ১৯ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন ৮ জন। তবে তাদের অধিকাংশ চিকিৎসক পালা করে সপ্তাহে দুই-তিন দিন হাসপাতালে আসেন। ৩৭ জন চিকিৎসককে চার উপজেলার ১২ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা সামলাতে হয়। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা অবকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিত্যক্ত। চিকিৎসক না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে এই চার উপজেলায়।
হাওরবাসী জানান, সাধারণ অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা কিংবা মারামারিতে কেউ আহত হলে চিকিৎসকের অভাবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা না পেয়ে যেতে হয় জেলা সদর হাসপাতাল কিংবা অন্য কোনো হাসপাতালে। অনেকে বাধ্য হয়ে শহরে যান অথবা থাকেন বিনা চিকিৎসায়।
অষ্টগ্রামের ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন পিপলু জানান, ডাক্তার সংকটের কারণে হাওরে চিকিৎসা সেবা কার্যত বন্ধ। এখানে চিকিৎসকরা খুব অল্প সময়ের জন্য সপ্তাহে পালা করে হাসপাতালে আসেন।
ইটনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (টিএইচও অ্যান্ড এফপিও) মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে হাওরের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক ভালো। তবে চিকিৎসক সংকট রয়েছে।
সিভিল সার্জন হাবিবুর রহমান জানান, হাওরের চার উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক নেই- বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আশা করি, কিছু দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে।
হাওরে কর্মরত কয়েক চিকিৎসকের কাণ্ড
বিস্ময়কর হলেও সত্য, নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ডা. পপি আক্তার কাজ করছেন কাপাসিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে; ডা. জিয়াউদ্দিন কাজ করছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে; ডা. শামীমা আফরোজ কাজ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে; ডা. সাদিয়া জাহান কাজ করছেন কুর্মিটোলা হাসপাতালে।
মিঠামইন উপজেলায় কর্মরত ডা. শহীদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। মীর নূর উসমাত কাজ করছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ডা. ফারহানা ইসলাম কাজ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
অষ্টগ্রাম উপজেলায় কর্মরত ডেন্টিস্ট ডা. তানভীর আসবান কাজ করছেন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে, ডা. নাজমুল হাসান ভূঞা কাজ করছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, গাইনি বিশেষজ্ঞ সানজীদা শামস কাজ করছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ইটনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ডা. প্রসেনজিৎ সাহা চৌধুরী ও ডা. তিথি রায় দীর্ঘ দিন ধরে অনুপস্থিত। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ডা. মুন্সি মো. বেলাল কিশোরগঞ্জ হাসপাতালে এবং গাইনি বিশেষজ্ঞ তাসলিম আরা কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে কাজ করেন। অথচ কর্মরত সবাই হাওরের ওই চার উপজেলা থেকে তাদের মাসিক বেতন উত্তোলন করেন।
এ ব্যাপারে জেলা বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল ওয়াহাব বাদল বলেন, তারা কী কারণে প্রেষণে অন্যত্র কাজ করছেন, তা জেনে কথা বলতে হবে।
সিভিল সার্জন হাবিবুর রহমানের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সূত্র : চিকিৎসক সংকটে সেবা বঞ্চিত হাওরবাসী [সমকাল, ১৯ জুলাই ২০১৭]