বৃহস্পতিবার। ২০ জুলাই ২০১৭। দুপুরে পল্টন থেকে বাসে উঠে একটা খালি সিট পেলাম। জানালার পাশে আমি বসলাম, আর পাশের সিটটা খালি! একটু পরেই দেখি ১৮/২০ বয়সী একটা সুন্দরী মেয়ে উঠলো। বোরকা পরা, মাথায় হিজাব দেয়া। মেয়েটাকে একনজর দেখলেই বোঝা যায় খুবই ভদ্র ও অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে। এদিক-ওদিক সিট খুঁজে না পেয়ে শেষে আমার পাশে এসে বসলো। হাতে একটা মোবাইল। দেখে বোঝা যায় অনেক দামী একটা মোবাইল। কিছুদূর যাবার পর বাস আবার জ্যামে পড়লো। মেয়েটা বলে উঠলো, অসহ্য জ্যাম! আমিও হুম বলে সম্মতি জানালাম। এরপর টুকটাক কথা হতে লাগলো। বাসও চলতে শুরু করলো! কথায় কথায় জানলাম, মেয়েটি ইংরেজিতে অনার্স করছে। খুবই ফ্রি ভাবে কথা বলছিলাম আমরা!
বংশালের (পুরান ঢাকা) ওখানে গিয়ে আবারও জ্যামে পড়লো বাস। বিরক্তিকর জ্যাম! জ্যামের মধ্যেই বাসে উঠলো সাদা শার্ট পরা কালো চেহারার মধ্যবয়সী একটা লোক। অনেক দিনের পুরনো বোধ হয় শার্টটা! ময়লা হয়ে আছে। তার হাতে অনেকগুলো নামাজ শিক্ষা বই। কাঁধে কালো রঙের একটা ব্যাগ। লোকটা নামাজ শিক্ষা বই বিক্রি করছেন! লোকটা অনেকক্ষণ যাবৎ, বইতে কি কি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া, সূরা, মাসালা ইত্যাদি আছে তা বর্ণণা করলো। কিন্তু বাসের কেউ একটা বইও কিনলো না! আমার খুব খারাপ লাগলো। ইচ্ছে করছিল লোকটাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করি! কিন্তু, লোকটাকে টাকা দিতে চাইলে যদি কিছু মনে করে। তাই দিলাম না! একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, লোকটা বাসে ওঠার পর থেকে মেয়েটি আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। মাথা নিচু করে মোবাইল টিপতেছে!
বাড়িতে নামাজ শিক্ষা বই থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র লোকটিকে সাহায্য করার ইচ্ছায় ২০ টাকা দিয়ে একটা বই কিনলাম। লোকটিকে পঞ্চাশ টাকার নোট দিলে সে ত্রিশ টাকা ফেরত দিল! টাকা ফেরত দেবার পরেও দেখি সে পকেট থেকে আরও টাকা বের করছে! একটা একশ টাকার নোট আর কয়েকটা দশ টাকার নোট। আমার দিকে এগিয়ে ধরলো! আমি তো অবাক। আমাকে টাকা দেবেন কেন উনি? আমার ভুল ভাঙলো তার ডাক শুনে! তিনি আমাকে না মেয়েটিকে টাকা দিচ্ছেন!
তিনি বললেন, ‘সোমা টাকাটা রাখো। কিছু কিনে খেয়ে নিও! তোমার মা বললো, ‘তুমি সকালে না খেয়েই ভার্সিটিতে চলে আসছো’। মেয়েটি লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। সে অত্যন্ত রেগে লোকটার দিকে তাকালো!
বললো, লাগবে না! লোকটি জোর করে টাকাটা তার হাতে দিয়ে বাস থেকে নেমে গেল!
মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না! রেগে টং হয়ে আছে! আমি কৌতুহল সামলাতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে টাকা দিল উনি কে? মেয়েটা বললো, আমাদের বাড়ির পাশে থাকে! আমি বললাম, কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলি, উনি কি আপনার বাবা? মেয়েটি রেগে তাকালো আমার দিকে! জবাব দিলো, না! এমন ভাব করলো যেন আমি মহা অপরাধ করে ফেলেছি। আমি বুঝতে পারলাম তার রাগের কারণ। তার বাবা একজন ভ্রাম্যমান হকার। বাসে বাসে ঘুরে বই বিক্রি করেন। আর সে দামী পোশাক পড়ে ভার্সিটিতে যায়! সে একজন শিক্ষিত মানুষ! এজন্য সে বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়! এই ময়লা শার্ট পরা লোকটাকে বাবা বলে স্বীকার করাটাকে সে ঘৃণার চোখে দেখে!
সে চায় না দুনিয়ার কেউ জানুক এই হকার তার বাবা! কত বড় বিবেকসম্পন্ন মানুষ সে! যে লোকটা রাত-দিন পরিশ্রম করে বাসে বাসে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বই বিক্রি করে মেয়েটাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন। তাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। নিজে কয়েক বছরের পুরনো একটা শার্ট পড়ে অথচ মেয়েটিকে দামী পোশাক, ব্যাগ, দামী মোবাইল কিনে দিয়ে তার সমস্ত চাওয়া পূরণ করেছেন। সেই মানুষটাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে মেয়েটির! কত বড় নির্লজ্জ। যে মানুষটা তাকে লালন পালন করে এত বড় করলো, যারটা খেয়ে বেঁচে আছে তাকে বাবা বলে পরিচয় দিতে সমস্যা!
মেয়েটি হয়তো শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু তার ভেতরে বিবেক ও মানুষত্ব তৈরি হয়নি! হকার লোকটির প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠলো! লোকটা হাজার কষ্টের মাঝেও পরম মমতায় নিজের মেয়েটিকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলছেন! আদর্শ বাবা মনে হয় একেই বলে। অন্য কেউ হলে হয়তো অনেক আগেই মেয়েটিকে কোনো শ্রমিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত। সেটাই বোধহয় ভাল হত! তাহলে তখন হয়তো মেয়েটি বাবার পরিচয় অস্বীকার করতো না!
তাই আবারও বলছি; “যে শিক্ষা আমাদের মধ্যে বিবেক ও মনু্ষ্যত্ব তৈরি করে না, কি লাভ সেই শিক্ষা গ্রহণ করে?”
লেখক : ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকাস্থ নিকলী সমিতি, ঢাকা।