মৃত্যুদণ্ড দেশে বিদেশে যুগে যুগে-১৭
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল ১ অক্টোবর ২০১৩-তে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর-এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল তাদের রায়ে বলে, রাষ্ট্রপক্ষের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই অভিযোগের মধ্যে চারটিতে মৃত্যুদণ্ড, তিনটিতে বিশ বছর করে কারাদণ্ড এবং দুটিতে পাচ বছর করে কারাদণ্ড দেয় আইসিটি।
মোট ছয়বার এমপি নির্বাচিত হওয়া সুবক্তা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী-ই প্রথম কোনো বিএনপি নেতা যার বিরুদ্ধে আইসিটি মৃত্যুদণ্ড দেয়।
বিচারপতি যখন রায় পড়া শুরু করেন সেই সময় কাঠগড়ায় বসে থাকা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, এসব তো আগেই বিভিন্ন অনলাইনে ফাস হয়ে গেছে। এগুলো পড়ে কি করবেন?
রায়ের পরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ফখরুল ইসলামও একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আজ যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে তার হুবহু কপি কয়েকদিন আগেই ইন্টারনেটে ফাস হয়ে গেছে। প্রশ্নপত্র ফাস হলে কি তার উপর পরীক্ষা হয়? কাজেই রিট্রায়াল হওয়া উচিত। তা না হলে আমরা মনে করবো আমরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়।
তবে অনলাইনে রায় ফাস হয়ে যাবার বিষয়টিকে নাকচ করে দেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগ ‘অনুমান নির্ভর’।
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, রায় ফাস হয়ে যাবার যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটি বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি ষড়যন্ত্র।
কিন্তু অনলাইনে খবর ও অন্যান্য প্রসঙ্গ পড়তে অভ্যস্ত পাঠকরা বলেন, এটর্নি জেনারেল এবং আইন প্রতিমন্ত্রী সম্ভবত অনলাইন বিষয়ে অজ্ঞ অথবা অনভ্যস্ত। তাই তারা বিশ্বের আধুনিকতম মিডিয়া সম্পর্কে অবলীলায় এমন মন্তব্য করেছেন।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যখন আদালতে আনা হয় তখন তিনি হাসি মুখে ছিলেন। রায় পড়ার সময় কিংবা তার পরেও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যদের একেবারেই বিচলিত কিংবা উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। রায় পড়ার সময় তারা মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে কথা বলেন এবং হাসি মুখেই ছিলেন।
বিচারপতিরা যখন রায় পড়েন তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রায়ই কিছু মন্তব্য করেন। রায় ঘোষণার পরপরই তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সম্পর্কে ট্রাইবুনাল রায়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়। ট্রাইবুনাল বলে তিনি ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু তার আচরণ ছিল আদালতের প্রতি অসম্মানজনক এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তবে রায়ের ক্ষেত্রে সে আচরণের কোনো প্রভাব পড়েনি বলেও ট্রাইবুনাল উল্লেখ করে।
এ সময়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘নেভার’ (Never, কখনোই না) । অর্থাৎ, তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো আচরণ তিনি কখনোই করেন নি।১৭তম পর্ব
মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশে বাড়ছেই
বাংলাদেশে সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে অন্তত ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জয়পুরহাটে যৌতুকের টাকা না পেয়ে স্ত্রী রুলিয়া বেগমকে ১৯৯৯-এ শ্বাসরোধ করে হত্যার অপরাধে স্বামী মোকাররম হোসেনকে (৩৯) জয়পুরহাটের অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারক মিজানুর রহমান সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে এই রায় দেন।
সুনামগঞ্জে একটি বাকবিতণ্ডার পরে বাবা হাশমত আলীকে ২০০৪-এ কুপিয়ে হত্যা করে তার ছেলে মোসলেম উদ্দিন। এই অপরাধে সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কাজী আবদুল হান্নান মৃত্যুদণ্ড দেন মোসলেম উদ্দিনকে।
লক্ষ্মীপুরে ১৮ জুলাই ২০১২-তে স্কুল ছাত্রী স্মৃতি রানী সীমাকে (১৩) ধর্ষনের পর হত্যার দায়ে আদালত সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। লক্ষ্মীপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ মঞ্জুরুল বাছিদ এই রায় দেন। মামলায় অপর ১৪ জন আসামিকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। লক্ষীপুরে একটি মামলায় ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ ছিল এই প্রথম। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে পাচ জন পলাতক।
ঢাকার ধামরাই উপজেলার চৌহাট ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চরচৌহাট গ্রামের নাজমুল হুদা পান্নাকে ৬ মার্চ ২০১২-তে কুপিয়ে হত্যার দায়ে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের বিচারক এবিএম সাজেদুর রহমান ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে আবদুর রশিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আবদুর রশিদ এখন পলাতক। একই মামলায় ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় যার মধ্যে দুইজন পলাতক। অন্য আট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
জাতিসংঘের তথ্য
জাতিসংঘের একটি সূত্রের মতে জাতিসংঘের ১৯৫টি স্বাধীন সদস্য দেশগুলোর মধ্যে :
ষ ১০০টি দেশ (৫১%) মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে।
ষ ৭টি দেশ (৪%) মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে শুধু খুবই অসাধারণ পরিস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধের জন্য, যেমন যুদ্ধের সময়ে।
ষ ৪৮টি দেশ (২৫%) সাধারণ অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও অন্তত ১০ বছর তারা সেটা কার্যকর করেনি।
ষ ৪০টি দেশ (২০%) আইনত এবং কার্যত মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে।
চায়নাতে সবচেয়ে বেশি
চায়নাতে প্রতি বছরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে ইরান ও সিংগাপুরে প্রতি বছরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
চায়না পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার যে সংখ্যা চায়নিজ সরকার প্রকাশ করে, তার চাইতে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। দুই হুয়া ফাউন্ডেশন (Dui Hua Foundation)-এর হিসাব মতে ২০০৯-এ চায়নাতে ৫,০০০ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অর্থাৎ, বিশ্বের অন্যান্য সব দেশে সম্মিলিতভাবে যতজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে তার চাইতে অনেক বেশি। তবে চায়নিজ সরকার পরিচালিত বিভিন্ন জনমত জরিপে জানা যায় অধিকাংশ চায়নিজ নাগরিক মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী।
কমিউনিস্ট চায়নার প্রয়াত দুই নেতা, মাও সে তুং এবং দেং জিয়াও পিং, উভয়েই মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ছিলেন। কমিউনিস্ট রাশিয়ারও প্রয়াত দুই নেতা, ভøাদিমির লেনিন ও জোসেফ স্টালিন, উভয়েই মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট আদর্শ ও নীতির উদগাতা কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এংগেলস, উভয়েই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী ছিলেন। তারা মনে করতেন মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে পূজিবাদী পীড়ন (Capitalist oppression)-এর প্রতীক।
আমেরিকায় সীমিত
ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা বা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৩২টিতে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে। তবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ সীমিত রাখা হয়েছে। এর ফলে মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তি কোনো নৃশংস খুন করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
২০১০-এ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ জন দণ্ডিত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ওই বছরে ডেথ রো-তে ছিলেন ৩,১০৮ দণ্ডিত ব্যক্তি। ২০১৪-তে আমেরিকায় দু’টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় এই বিষয়টি নিয়ে আবার জোরালো বিতর্ক চলছে সেই দেশে।
আগামী পর্বে আমেরিকায় সর্বশেষ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে লেখা থাকবে।
শ্রী লংকায় সমস্যা
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে গিয়ে ২০১৪-তে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে শ্রী লংকা। ১১ মার্চ ২০১৪-তে শ্রী লংকার কমিশনার জেনারেল অফ পৃজনস চন্দ্ররতœ পালেগামা বলেন, ভবিষ্যতে কোনো জল্লাদকে ট্রেইনিং দেয়ার আগে তাকে ফাসির মঞ্চ দেখান হবে। তিনি জানান, সর্বশেষ যে জল্লাদকে নিয়োগ করা হয়েছিল, সে তার জীবনে সর্বপ্রথম ফাসির মঞ্চ দেখার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং চাকরি ছেড়ে দেয়। এই ব্যক্তিকে ১৭৬ জন আবেদনকারীর মধ্য থেকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। এর আগে দু’জনকে নিয়োগপত্র দিলেও জয়েনিং তারিখে তারা উপস্থিত হয়নি।
কমিশনার জেনারেল অফব পৃজনস বলেন, এই লোকটিকে আমরা এক সপ্তাহ ট্রেইনিং দিয়েছিলাম। তারপর ফাসির মঞ্চ দেখে সে বলে, এই কাজ করতে সে ইচ্ছুক নয়। সে বলে, সে খুব আপসেট হয়ে পড়েছে… এরপর আমরা যাকেই নিয়োগ করি না কেন, তাকে আগে ফাসির মঞ্চ দেখিয়ে তারপর বেসিক ট্রেইনিং দেই।
শ্রী লংকার ৬৯% মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বী। ১৯৭৬-এর পরে শ্রী লংকায় কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি, যদিও ডেথ রো-তে দণ্ডিত ৪০৫ জন অপরাধী আছে।
মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান
এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে জানা যায়, বিশ্বের মোট ৫৩টি মুসলিমপ্রধান দেশের (আফৃকা ২৪, এশিয়া ২৪ ও ইওরোপ ৫) মধ্যে ১২টি দেশ মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। এই ১২টি দেশ হচ্ছে :
ষ ইওরোপে (৫) এলবানিয়া, আজারবাইজান, বসনিয়া-হার্জগভিনা ও টার্কি।
ষ আফৃকাতে (৪) আইভরি কোস্ট, জিবুতি, গিনি বিসাউ ও সেনেগাল।
ষ এশিয়াতে (৩) কিরগিজস্তান, টার্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান।
নিচে মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান লিস্ট দেওয়া হলো।
উল্লেখ্য যে,
১. ব্রুনেই ও মালদ্বীপে শেষ যে বছরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় তখন দেশ দুটি বৃটিশ কলোনি ছিল।
২. কসোভোর মুসলিম জনসংখ্যা কত এবং কোন সালে সেখানে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয় সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
৩. ব্র্যাকেটে বিভিন্ন দেশের মুসলিম জনসংখ্যা দেওয়া হয়েছে ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী।
ইরানি কবি হাশেম শাবাানির ফাসি
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে ইরানে প্রতি বছরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
জানুয়ারি ২০১৪-তে কবি হাশেম শাবানি-র (৩২) ফাসি বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় তোলে। ইরানের সংখ্যালঘু আহওয়াজি আরব সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন কবি শাবানি। আহওয়াজি আরবদের একটি নিষিদ্ধ সংস্কৃতিক সংগঠনের অন্যতম নেতা ছিলেন শাবানি। ২০১১-তে তিনি এবং অন্তত আরো চার ইরানি আরব সহযোগী গ্রেফতার হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মানব অধিকার সংস্থাগুলো বলে শাবানি ও তার সহযোগীদের অন্যায় বিচার ও মৃত্যুদণ্ড হয়।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার এক মাস আগে শাবানিকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির করানো হয়। সেখানে তিনি আত্মসমালোচনা করেন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। কিন্তু ইরানে সক্রিয় কর্মীরা বলেন, ওই স্বীকৃতি দিতে শাবানিকে বাধ্য করা হয়েছিল।
শাবানির জন্ম হয়েছিল ইরানের দক্ষিণÑপশ্চিমে খুজেস্তান প্রদেশে রামশির-এ। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের (মোহারেবে) অভিযোগে তাকে ফাসি দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, ইরানে বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সন্ত্রাসী সংস্থার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। সংবাদে জানানো হয়, শাবানির সঙ্গে তার এক সহযোগী সাংস্কৃতিক কর্মী হাদি রাশেদি-রও ফাসি হয়।
ইরানি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ (আইএইচআর, IHR) -এর মতে, জেল কর্তৃপক্ষ ওই দুইজনের পরিবারকে জানিয়েছিল জানুয়ারি ২০১৪-তে তাদের ফাসি হয়ে গিয়েছে কিন্তু ফাসির কোনো তারিখ, সময় এবং স্থানের নাম জানানো হয় নি। তাদের সঙ্গে ধৃত আরো তিন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা জানা যায় নি।
ইরানের মানব অধিকার কর্মীরা বলেন, ওই দুইজন আল-হাইওয়ার (Al- Hiwa বা সংলাপ) নামে আরবি সাহিত্য ও শিল্পকলায় নিবেদিত সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটের সদস্য ছিলেন। ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি-র সংস্কারমুখি কর্মসূচির অনুসরণে এই ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০৫-এ তেল সমৃদ্ধ খুজেস্তান প্রদেশের ইরানি আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাদেশিক রাজধানী আইওয়াজে ব্যাপক বিক্ষোভের অজুহাতে তাদের ইন্সসিটিটিউট নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরব সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ইরান সরকার দমন নীতি চালিয়ে গণ গ্রেফতার করেছে এবং গোপন আদালতে আরবদের গণবিচার করে কড়া শাস্তি দেওয়া হয়।
ইরানের আরেকটি মানব অধিকার সংস্থা, জাস্টিস ফর ইরান, গবেষণা করছে ইরানি আরবদের সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় তাদের সংগ্রামের বিষয়টি। জাস্টিস ফর ইরান জানিয়েছে, শাবানি বিবাহিত ছিলেন এবং তার একটি তিন বছরের কন্যাসন্তান আছে। গ্রেফতার হবার আগে আহওয়াজ ইউনিভার্সিটিতে শাবানি পলিটিক্সে মাস্টার্স ডিগৃর জন্য পড়াশোনা করছিলেন। ইউনিভার্সিটিতে তিনি আখলামÑওলতালাকে (ছাত্রদের কলম) নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকায় আরবি কবিতা প্রকাশিত হতো। উল্লেখ্য, ইরানের প্রধান ভাষা ফার্সি। ২০০২-এ ইউটিউবে পোস্ট করা একটি ছবিতে শাবানিকে তার লেখা কবিতা পড়তে দেখা যায়।
এমনেস্টি ইন্টারন্যশনালের ইরান বিশেষজ্ঞ ড্রুয়ারি ডাইক (Drewery Dyke) লন্ডনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেন, হাশেম শাবানি ছিলেন একজন শিক্ষক, কবি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় স্বাধীনচেতা ব্যক্তি। ইরানের আহওয়াজি আরব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিচারিকভাবে হত্যা (জুডিশিয়াল কিলিং) করা হচ্ছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় শাবানিকে গোপনে ফাসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এর কিছুদিন আগে আহওয়াজি আরব এলাকায় সফরের সময়ে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের নিন্দা করেছিলেন।
আমেরিকা ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মুখপাত্র ফরাজ মানেই বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, শাবানা ও রাশেদির ফাসি ছিল ঘোর অন্যায়। আত্মসমর্থনের সুযোগ দেওয়ার আগে তাদের দীর্ঘকাল আটক রেখে দৈহিক ও মানসিক টর্চার করা হয়েছিল। এখন কর্তৃপক্ষ তাদের কবর দেওয়ার জন্য মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হচ্ছে না। … ইরানের বিচার বিভাগ সংখ্যালঘু মানব অধিকার কর্মীদের খুব দ্রুতগতিতে ফাসিতে যে ঝুলিয়ে দিচ্ছে এই ঘটনা তার আরেকটি দৃষ্টান্ত।
ইরানে দীর্ঘকাল জুড়ে আহওয়াজি আরব সম্প্রদায় শিক্ষা, রাজনীতি, কর্ম সংস্থান এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের প্রতিবাদ করে আসছে। এরা সবাই ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পক্ষপাতী নয়। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদি হবার অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে।
ইরানে কিশোরি আতেফার মৃত্যুদণ্ড
সাম্প্রতিক কালে ইরান স্বদেশে ও বিদেশে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয় ১৬ বছরের কিশোরী আতেফা রাজাবি সালেহ-কে ফাসি দেওয়ায়।
আতেফার বয়স যখন পাচ তখন তার মা একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। এর কয়েক দিন পরে তার ছোট ভাই নদীর পানিতে ডুবে মারা যায়। শোকে দুঃখে আতেফার পিতা ড্রাগস আসক্ত হয়ে পড়ে। আশি উর্ধ দাদাÑদাদিকে দেখাশোনার দায়িত্ব কিশোরী আতেফাকে নিতে হয়। কিন্তু এই পরিচর্যার বিনিময়ে কোনো দিনই কোনো মায়া-মমতা ওই বৃদ্ধ জুটি দেখান নি আতেফার প্রতি। আতেফা বেড়ে ওঠে ইরানের নেকা শহরে যেখানে সে পরিচিত হয় বুদ্ধিমতি ও প্রাণোচ্ছল মেয়ে হিসেবে। বাড়িতে তার কোনো বন্ধন ছিল না। তাই সে প্রায়ই পথে ঘুরে বেড়াত।
আতেফার এই আচরণের সুযোগ নিয়ে ৫১ বছর বয়সী এক পুরুষ তাকে ধর্ষণ করে। আলি দারাবি নামে এই পুরুষটি এক সময়ে বিপ্লবী সেনাবাহিনীতে কাজ করত। পরে ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়েছিল। সে বিবাহিত ছিল এবং তার ছেলেমেয়ে ছিল।
আতেফাকে একবার ধর্ষন করে আলি দারাবি থেমে যায়নি। সে বুঝেছিল গভীর লজ্জায় বিষয়টি আতেফা কাউকে খুলে বলতে পারবে না। এমনকি তার দাদাÑদাদিকেও নয়। (বাংলাদেশেও বহু ধর্ষিতা নারী কলংকিনী রূপে সমাজে অপমানিত হবার আশংকায়, ধর্ষন এবং ধারাবাহিক ধর্ষনের ঘটনা আজীবন গোপন রাখেন।)
এরপর আলি দারাবি টানা তিন বছর আতেফাকে ধর্ষন এবং বিভিন্ন ধরনের যৌন টর্চার করে যায়। বিষয়টি পুলিশ জানার পরে আতেফাকে গ্রেফতার করে। তখন জেলে থাকা অবস্থায় আতেফা তার দাদিকে ঘটনাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে। আতেফা বলে তাকে আলি দারাবি এত যৌন অত্যাচার করতো যে এক সময়ে সে ব্যথায় হাটাচলা করতে পারত না। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হতো।
আদালতে বিচারক ছিলেন হাজি রেজাই। আতেফা যখন বুঝতে পারে যে বিচারক তার কথা বিশ্বাস করছেন না এবং ফলে তার শাস্তি হবেই, তখন সে তার হিজাব খুলে বলে, শাস্তি হওয়া উচিত আলি দারাবির Ñ তার নয়।
ইরানে হিজাব খোলাটাকে চরম আদালত অবমাননা রূপে গণ্য করা হয়। রাগে দুঃখে আতেফা আদালতকে আরো অপমান করে। এক পর্যায়ে সে তার জুতা খুলে বিচারককে ছুড়ে মারে। এরপর বিচারক তাকে ব্যভিচার ও ‘কুমারিত্বের বিরুদ্ধে অপরাধের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেন।
রায়টি আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র সমালোচিত হয়। কারণ ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি’-তে (International Covenant on Civil and Political Rights) ইরান অন্যতম স্বাক্ষরদাতা দেশ যেখানে ১৮ অনূর্ধ্ব কাউকে মৃত্যুদণ্ড না দিতে ইরান অঙ্গীকার আবদ্ধ।
আতেফার আত্মীয়-স্বজন যখন মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সুপৃম কোর্টে আপিল করেন তখন কর্তৃপক্ষ একটি নতুন কৌশল করে। বিবিসি জানায়, সুপৃম কোর্টে যেসব নথিপত্র পুলিশ জমা দেয় তাতে দেখানো হয় আতেফার বয়স ২২। কিন্তু আতেফার বার্থ (জন্ম) সার্টিফিকেটে এবং ডেথ (মৃত্যু, ১৫ আগস্ট ২০০৪) সার্টিফিকেটে তার বয়স ছিল ১৬।
চূড়ান্ত রায়ের সাত দিন পরেই নেকা শহরে নির্মীয়মান একটি ভবনের পাশে উচু ক্রেইন থেকে ফাসিতে ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে আতেফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অভিযোগ ওঠে বিচারক হাজি রেজাই সেখানে এসে নিজের হাতে আতেফার গলায় ফাসির রশি পরিয়ে দিয়েছিলেন।
এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ বিশ্বজুড়ে অন্যান্য মানব অধিকার সংস্থাগুলো বলে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে এবং এটি বিশ্বের শিশুদের প্রতি অপরাধ।
এই ঘটনাটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝে বিবিসি একটি গোপন মুভি মেকিং টিম পাঠিয়ে দেয় ইরানে। সেখানে মুভি ডিরেক্টর মিজ মনিকা গার্নসি এবং সহ প্রযোজক আরাশ সাহামি গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে একটি ডকুমুভি বানান। এছাড়া ডিসকভারি টিভি-ও “একজিকিউশন ইন ইরান” (ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া) নামে এক ঘণ্টার ডকুমুভি বানায়।
আন্তর্জাতিকভাবে ইরান খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাওয়ার ফলে কর্তৃপক্ষ নতুন তদন্ত করে। ইরানি মিডিয়া জানায় বিচারপতি রেজাই এবং ক্যাপ্টেন জাবিহি ও ক্যাপ্টেন মোলাইসহ কয়েকজন আধাসামরিক ব্যক্তিকে গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় গ্রেফতার করে।
এরপর ইরানের সুপৃম কোর্ট রায় দেন বিচারক রেজাই যথাযথভাবে মামলাটি পরিচালনা করেন নি এবং আদেশ দেন আতেফাকে মুক্ত করে দিতে।
কিন্তু মরণোত্তর মুক্তির আদেশ বিশ্বে এটাই ছিল প্রথম। ইরানি আদালত কোনোদিনই বলেন নি মরণোত্তর মুক্তির অর্থাৎ পুনর্জীবিত করার আদেশ কিভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব।
সোমালিয়াতে পাথর ছুড়ে হত্যা
ইসলামি দেশগুলোতে বিভিন্ন পন্থায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যেমন, ফাসি, শিরñেদ, পাথর ছুড়ে হত্যা।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তে সোমালিয়ার উপকূলবর্তী জেলা বারাউই-তে এক সোমালি নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় পাথর ছুড়ে। এএফপি-র খবরে জানানো হয় ওই নারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল সে গোপনে একাধিক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিল। একটি ইসলামি আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে, এরপর ওই নারীকে গলা পর্যন্ত মাটিতে পুতে ফেলা হয়। তারপর প্রকাশ্যে কয়েক ব্যক্তি পাথর ছুড়ে তাকে হত্যা করে।
ইজিপ্টে ৫২৯ জনকে পাইকারি মৃত্যুদণ্ড
২০১৪-তে ইজিপ্টে ক্ষমতাচ্যুত, ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত, প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির ৫২৯ জন সমর্থককে ফাসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন একটি আদালত। তাদের বিরুদ্ধে সামরিক সরকার পক্ষের অভিযোগ বলা হয়, তারা ছিলেন হত্যা মামলার আসামি।
বর্তমানে ইজিপ্টে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্তত ১,২০০ সমর্থক আদালতে বিচারাধীন আছেন। এই মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তিরাও ওই বিচারাধীন আসামিদের মধ্যে আছেন।
মৃত্যুদণ্ড বিরোধী টার্কি
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থান নিয়েছে টার্কি। এর পেছনে দুটি বড় কারণ আছে।
এক. টার্কি হতে চেয়েছিল ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের বা ইইউ-য়ের সদস্য। এই সদস্য পদ লাভের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সদস্য দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করতে হবে।
দুই. টার্কির জনপ্রিয় ও নির্বাচিত নেতা আদনান মেন্দারেস, যিনি দশ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাকে পদচ্যুত করে অন্যায়ভাবে সামরিক আদালতের বিচারে ফাসি দেওয়া হয়েছিল। সেই পাপ স্খলনের জন্য টার্কিতে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন ছিল। মেন্দারেসের সংক্ষিপ্ত জীবনী নিচে দেওয়া হলো।
এয়ার ক্র্যাশে জীবিত ফাসিতে মৃত
আদনান মেন্দারেসের জন্ম হয়েছিল ১৮৯৯-এ টার্কির একটি ধনী জমিদার পরিবারে। তিনি ইজমির-এ আমেরিকান কলেজে পড়াশোনা করেন। টার্কির স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি হানাদার গৃক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং বীরত্বের জন্য সম্মাননা পদক পান। আংকারা ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর মেন্দারেস সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। লিবারাল ডেমক্রেটিক পার্টি নামে একটি বিরোধী দলের শাখা সংগঠন করেন। মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক সব বিরোধী দল নিষিদ্ধ করলে এই দলটিও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবে মেন্দারেসের মেধা ও সাংগঠনিক শক্তি দেখে আতাতুর্ক তাকে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পিপলস পার্টিতে যোগ দিতে বলেন। মেন্দারেস তাই করেন।
আধুনিক টার্কির প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামালের জন্ম (১৮৮১) হয়েছিল গৃসে, সালোনিকাতে। পরে তার নামের শেষে আতাতুর্ক শব্দটি যোগ হয়, যার মানে হচ্ছে টার্কিশ জাতির পিতা। ১৯৩৮-এ কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুর পরে দলের ক্ষমতা চলে যায় ইসমেত ইনোনুর হাতে। স্বঘোষিত ‘জাতীয় প্রধান’ ইনোনুর রাষ্ট্রায়ত্তকরণ নীতির বিরোধিতা করলে মেন্দারেস ও তার দুই সহযোগী দল থেকে বহিষ্কৃত হন। সেই থেকে টার্কিশ পলিটিক্সে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হন ইনোনু ও মেন্দারেস।
১৯৪৬-এ সাবেক প্রধানমন্ত্রী সেলাল বায়ার এবং মেন্দারেস প্রতিষ্ঠা করেন ডেমক্রেটিক পার্টি (ডিপি) যেটা ছিল টার্কির চতুর্থ বৈধ বিরোধী দল। ১৪ মে ১৯৫০-এ টার্কির ইতিহাসে প্রথম অবাধ নির্বাচনে ৫২% ভোট পায় ডিপি। মেন্দারেস হন প্রধানমন্ত্রী। এর পরে আরো দুটি অবাধ নির্বাচনে ১৯৫৪ এবং ১৯৫৭-তে ডিপি বিজয়ী হয়। ১৯৫৫-তে প্রধানমন্ত্রী মেন্দারেস পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও নেন।
মেন্দারেসের প্রধানমন্ত্রিত্বের দশ বছরে টার্কির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বৈদেশিক নীতির বিশাল পরিবর্তন হয়। আতাতুর্ক যে শিল্পায়ন ও নগরায়ন শুরু করেছিলেন সেটা দ্রুত গতিতে আরো সামনে নিয়ে যান মেন্দারেস। টার্কির অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার হয় ৯% যেটা পরবর্তী কোনো সরকার পুনরাবৃত্তি করতে পারেনি। টার্কিকে নেটো-র সদস্য পদ দেওয়া হয় এবং মার্শাল প্ল্যানের অধীনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বড় অর্থনৈতিক সাপোর্ট পায়। কৃষিকাজে আসে যন্ত্র। বিদ্যুৎ ও যানবাহন চলাচল ব্যবস্থা হয় উন্নত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যাংকিং খাত হয় আধুনিক।
ইংল্যান্ডে এয়ার ক্র্যাশ
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯-এ টার্কিশ এয়ারলাইনসের একটি স্পেশাল ফাইটে ইস্তাম্বুল থেকে মেন্দারেস ও তার সরকারি কর্মকর্তারা লন্ডনের গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলেন। তারা যাচ্ছিলেন সাইপ্রাসের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ‘লন্ডন এগৃমেন্ট’-এ সই করতে।
সেদিন এয়ারপোর্ট ছিল ঘন কুয়াশায় ঢাকা। রানওয়ের কয়েক মাইল আগে ইংল্যান্ডে সাসেক্সের একটি গ্রামে ভুলক্রমে প্লেনটি নেমে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাতে আগুন ধরে যায়। এই দুর্ঘটনায় ক্রুসহ মোট চব্বিশ যাত্রীর মধ্যে ১৪ জন মারা যায়। মেন্দারেস পেছনের সিটে ছিলেন এবং অলৌকিকভাবে প্রায় অক্ষত অবস্থায় বেচে যান।
কিন্তু বছরখানেক পরেই মানুষের হাতে মৃত্যু মেন্দারেসের জন্য অপেক্ষা করছিল তারই দেশে।
টার্কিতে ফাসি
টার্কিতে হঠাৎ একদিন গুজব ছড়িয়ে পড়ে গৃসে, সালোনিকাতে মোস্তফা কামালের বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। এর প্রতিশোধে ইস্তাম্বুলের একাংশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গৃকদের দোকানপাট, বাড়িঘর, চার্চ এমনকি কবরস্থানও আক্রান্ত হয় দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বহু ব্যক্তি হতাহত হয়।
ইস্তাম্বুল গণহত্যা নামে এই ঘটনার জন্য প্রধানমন্ত্রী মেন্দারেসকে দায়দায়িত্ব নিতে হয়। এই সুযোগে ২৭ মে ১৯৬০-এ মেন্দারেস বিরোধী ৩৭ জন তরুণ আর্মি অফিসার একটি ক্যু করে। মেন্দারেস ও তার পার্টির সব নেতা গ্রেফতার হন। সংবিধান লংঘন, গণহত্যায় ৫৭ গৃক নিহত হবার অপরাধ ও দুর্নীতির দায়ে তারা অভিযুক্ত হন। ইয়াসি ইয়াদা দ্বীপে তাদের বিচার হয়। মেন্দারেস মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি, ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথসহ বহু বিশ্বনেতা, টার্কির রাষ্ট্রপতি সেমাল গুরসেল ও বিরোধী নেতা ইসমেত ইনোনু তাকে ক্ষমা করার অনুরোধ জানান আর্মিকে। কিন্তু আর্মি তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬১-তে ইমরালি দ্বীপে ফাসিতে মেন্দারেসের দণ্ড কার্যকর করা হয়।
মরণোত্তর ক্ষমা ও সম্মান
দুই মাস পরে সামরিক তত্ত্বাবধানে ইসমেত ইনোনু একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। সেটা স্থায়ী হয় না, বরং স্থায়ী হয় মেন্দারেসের প্রতি জনসমর্থন। মেন্দারেসের মতাদর্শে গঠিত নতুন পার্টি সুলেমান ডেমিরেলের নেতৃত্বে পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হয়। মেন্দারেস জাতীয় নেতা রূপে স্বীকৃত হন।
মেন্দারেস জনপ্রিয় হয়েছিলেন বহু কারণে। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশাল ধনসম্পত্তির অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে তিনি সম্মান করতেন এবং আতাতুর্কের তুলনায় ইসলামের বিভিন্ন রীতি বিষয়ে বেশি সহিষ্ণু ছিলেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং ছোট ব্যবসায়ীদের অনুকূলে ছিলেন মেন্দারেস।
কিন্তু মেন্দারেস সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। পত্রপত্রিকার ওপর সেন্সরশিপ চালু করেছিলেন। সাংবাদিকদের গ্রেফতার করেছিলেন। শিক্ষায়তন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিলেন। বিরোধী দল দমন করেছিলেন। আর্মি এবং ভোটারদের একাংশ তখন দৃঢ়বিশ্বাস করেছিল আতাতুর্কের নীতিমালা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন মেন্দারেস। এসবের ফলে বুদ্ধিজীবী মহলে এবং তরুণ আর্মি অফিসার মহলে তিনি জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিকরা বলেন, মেন্দারেসের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল দুর্নীতি দমনে তিনি যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন সেটাতে সদস্য ছিল শুধু তারই দল ডেমক্রেটিক পার্টির এমপি-রা এবং তাদের সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যেটা ছিল সংবিধানের ক্ষমতা বিভক্তিকরণ নীতির পরিপন্থী।
মেন্দারেসের মৃত্যুর ২৯তম বার্ষিকীতে, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯০-এ টার্কিশ পার্লামেন্ট তার প্রতি মরণোত্তর ক্ষমা ঘোষণা করে। তার দেহাবশেষ ইস্তাম্বুলে এনে নতুন সমাধিস্থল বানানো হয়। ইজমির এয়ারপোর্টের নাম হয় আদনান মেন্দারেস এয়ারপোর্ট। এছাড়া তার নামে ইউনিভার্সিটি, কলেজ ও স্কুল এবং বহু পথ ও পার্ক হয়েছে। টার্কিতে মাত্র তিন নেতার স্মরণে সমাধিস্থল হয়েছে এবং এরা হলেন কামাল আতার্তুক, টারগাট ওজাল ও আদনান মেন্দারেস।
প্লেন দুর্ঘটনা থেকে মেন্দারেসের বেচে যাওয়া এবং তারপর ফাসিতে তার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে একটি টিভি সিরিজ হয়েছে। মেন্দারেসের পূর্ণ জীবনী নির্ভর বহু টিভি সিরিজ হয়েছে।
মেন্দারেসের এমন মরণোত্তর সম্মান প্রমাণ করে যে সত্যিকারের জনপ্রিয় কোনো নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও তিনি জনতার হৃদয়ে বেচে থাকেন এবং প্রাপ্য আসনে ফিরে আসেন।
মৃত্যুদণ্ড দানকারী ক্ষমতাসীনদের লাভ হয় সাময়িক।
(চলবে)
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪
Facebook.com/Shafik Rehman Presents