ভারতভাগের নাটকীয় ঘটনাবলী, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে

আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।

ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় ভারতভাগের পটভূমি আর ঘটনাবলীর বর্ণনা আর বিশ্লেষণ করে বিস্তারিত লিখেছেন তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী সময়ে যিনি হয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি, সেই শেখ মুজিব সক্রিয় ছিলেন তখনকার পাকিস্তান আন্দোলনে – একবারে ভেতরে থেকে দেখেছেন নানা ঘটনাবলী। সেগুলো উঠে এসেছে তাঁর বয়ানেই, আর এ নিয়ে বিবিসি বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪০’র দশকের মাঝামাঝি ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভারতবর্ষে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। সেটির নাম ছিল ক্রিপস মিশন। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।

যুদ্ধের পর ক্লিমেন্ট অ্যাটলি যখন লেবার পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ই মার্চ ভারতবর্ষে কেবিনেট মিশন পাঠানোর ঘোষণা দেন। সে কেবিনেট মিশনে তিনজন মন্ত্রী থাকবেন, তাঁরা ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন দলের সাথে পরামর্শ করে ভারতবর্ষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাধীনতা দেয়া যায়, সে চেষ্টা করবেন।

কিন্তু তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কথায় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির কথা তো উল্লেখ নাই-ই, বরং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দাবিকে তিনি কটাক্ষ করেছিলেন।

মি: অ্যাটলির বক্তব্য নিয়ে কংগ্রেস সন্তোষ প্রকাশ করলেও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সে বক্তৃতার তীব্র সমালোচনা করেন।

কেবিনেট মিশন ২৩শে মার্চ ভারতবর্ষে এসে পৌঁছাল। তাঁরা ভারতবর্ষে এসে যেসব বিবৃতি দিয়েছিল, সেগুলো মুসলমানদের বিচলিত করে তোলে।

তখন শেখ মুজিবুর রহমান সহ মুসলিম লীগের তরুণ রাজনৈতিক নেতারা দলবলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে যেতেন। মি. সোহরাওয়ার্দী তখন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং মুসলিম লীগের সিনিয়র নেতা।

শেখ মুজিবুর রহমান সহ অপেক্ষাকৃত তরুণরা মি. সোহরাওয়ার্দীর কাছে জানতে চাইতেন, কী হবে? সে সময় মি. সোহরাওয়ার্দী শান্তভাবে উত্তর দিতেন, “ভয়ের কোন কারণ নাই, পাকিস্তান দাবী ওদের মানতেই হবে।”

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে বিষয়টি এভাবেই বর্ণনা করেছেন।

তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৪৬ সালের ৭, ৮, ৯ই এপ্রিল মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দিল্লিতে সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলিম লীগ-পন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশন ডাকেন।

তখন সমগ্র ভারতবর্ষে ১১টি প্রদেশ ছিল। এরমধ্যে চারটি ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ। এই চারটির মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই এককভাবে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করেছিল।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আহবানে দিল্লি যাওয়ার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করতে বললেন। ট্রেনের নাম দেয়া হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল’। কলকাতার হাওড়া থেকে ছাড়বে সে ট্রেন।

শেখ মুজিবুর রহমান সহ ১০-১৫ জন ছাত্রকর্মী বাংলাদেশ থেকে সে কনভেনশনে যোগ দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পুরো ট্রেনটিকে মুসলিম লীগের পতাকা ও ফুল দিয়ে সাজানো হলো।

বাংলাদেশে মুসলিম লীগের জয়ে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।

‘নারায়ে তকবির’, ‘মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ জিন্দাবাদ’, ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল।

কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেশনে হাজার-হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেখার জন্য। তারা ‘শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ’ এবং ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে থাকে।

ভারতভাগের আগে থেকেই শেখ মুজিব সহ অনেক তরুণ নেতার আদর্শ ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

এজন্য প্রায় আট ঘণ্টা দেরিতে ট্রেনটি দিল্লি পৌঁছাল।

এরপর আরো নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত হয়।

মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, ১৯৪৬ সালের ১৬ই অগাস্ট ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন করা হবে। দিনটি শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য তিনি বিবৃতি দিয়েছিলেন।

মি. জিন্নাহ ব্রিটিশ সরকার ও কেবিনেট মিশনকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে ভারতবর্ষের ১০ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায় করতে বদ্ধপরিকর।

কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য নেতা-কর্মীদের বলা হলো দিনটি সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য।

‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যরা প্রস্তুতি নিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে সেটি বর্ণনা করেছেন এভাবে, “হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে সভা করলেন। আমাদের বললেন, তোমাদের মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দিনটা পালন করি।

“আমরা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে বের হয়ে পড়লাম। হিন্দু মহল্লায় ও মুসলমান মহল্লার সামনে প্রোপাগান্ডা শুরু করলাম। অন্য কোন কথা নাই, ‘পাকিস্তান’ আমাদের দাবী। এই দাবি হিন্দুর বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে।”

হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা পরিস্থিতিতে কলকাতার রাস্তায় টহল দিচ্ছে ব্রিটিশ সৈন্য

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। দিনটি শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য তিনিও বলে দিলেন। মি. সোহরাওয়ার্দী ১৬ই অগাস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন। এতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা আরো ক্ষেপে গেল।

১৬ই অগাস্ট কলকাতার গড়ের মাঠে সভা হবে। সব এলাকা থেকে শোভাযাত্রা করে জনসাধারণ আসবে। কলকাতার মুসলমান ছাত্ররা ইসলামিয়া কলেজে সকাল দশটায় জড়ো হবার কথা। শেখ মুজিবুর রহমানকে ভার দেয়া হলো ইসলামিয়া কলেজে থাকতে এবং সকাল সাতটায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে।

সকালে তিনি ও নূরউদ্দিন সাইকেলে করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে সেখানে পতাকা উত্তোলন করলেন। কিন্তু কেউ তাদের বাধা দিল না।

এরপর তাঁরা আবার ইসলামিয়া কলেজে ফিরে আসেন। কিছুক্ষণ পরেই তাঁরা দেখেন, কয়েকজন ছাত্র রক্তাক্ত দেহে ইসলামিয়া কলেজে এসে পৌঁছেছে। কারও পিঠে ছুরির আঘাত, কারো মাথা ফেটে গেছে।

এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য শেখ মুজিবুর রহমান মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। আর এই অবস্থায় বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসলমানদের উপর হিন্দুদের আক্রমণের খবর আসছে।

ঐ পরিস্থিতির বর্ণনায় শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “আমাদের কাছে খবর এলো, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মসজিদে আক্রমণ হয়েছে। ইসলামিয়া কলেজের দিকে হিন্দুরা এগিয়ে আসছে। … আমরা চল্লিশ পঞ্চাশ জন ছাত্র প্রায় খালি হাতেই ধর্মতলার মোড় পর্যন্ত গেলাম।

“সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা কাকে বলে এ ধারণাও আমার ভালো ছিলনা। দেখি শতশত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক মসজিদ আক্রমণ করছে। মৌলভী সাহেব পালিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। তাঁর পিছে ছুটে আসছে একদল লোক লাঠি তলোয়াড় হাতে।”

দেশভাগের আগে ভারতের যেসব শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতা তার একটি

“পাশেই মুসলমানদের কয়েকটা দোকান ছিল। কয়েক জন লোক কিছু লাঠি নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াল। আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে অনেক লোক জমা হয়ে গেল। হিন্দুরা আমাদের সামনা-সামনি এসে পড়েছে।

“বাধা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ইট পাটকেল যে যা পেল তাই নিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করে গেল। আমরা সব মিলে দেড়শত লোকের বেশি হব না। কে যেন পিছন থেকে এসে আত্মরক্ষার জন্য আমাদের কয়েকখানা লাঠি দিল। এর পূর্বে শুধু ইট দিয়ে মারামারি চলছিল।

“এর মধ্য একটা বিরাট শোভাযাত্রা এসে পৌঁছাল। এদের কয়েক জায়গায় বাধা দিয়েছে, রুখতে পারে নাই। তাদের সকলের হাতেই লাঠি। এরা এসে আমাদের সাথে যোগদান করল। কয়েক মিনিটের জন্য হিন্দুরা ফিরে গেল, আমরাও ফিরে গেলাম।”

সমগ্র কলকাতায় তখন মারামারি চলছে।

শেখ মুজিবের বর্ণনা অনুযায়ী, মুসলমানরা মোটেই সে দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে দাঙ্গার সময় তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে কিছু হিন্দু পরিবারকেও রক্ষা করেছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ১৬ই অগাস্ট মুসলমানরা ভীষণভাবে মারা খেয়েছে এবং পরের দুই দিন মুসলমানরা হিন্দুদের ভীষণভাবে মেরেছে।

কলকাতার দাঙ্গায় অন্তত ২,০০০ জন নিহত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়

কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ না হতেই আবার দাঙ্গা শুরু হলো নোয়াখালীতে। মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করলো এবং আগুন ধরিয়ে দিল। ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই আছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় বিহারে শুরু হলো ভয়াবহ দাঙ্গা। বিহার প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় ‘মুসলমানদের উপর প্লান করে’ আক্রমণ হয়েছিল।

দাঙ্গা শুরুর তিনদিন পরেই শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাটনায় গিয়েছিলেন।

নানা অস্থিরতা, চড়াই-উতরাই ও আলোচনার পর ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ভারতবর্ষ ভাগ করার ঘোষণা এলো। কংগ্রেস ভারত ভাগ করতে রাজী হয়েছে এই জন্য যে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হবে।

আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। কলকাতা ও তার আশপাশের জেলাগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে। মাওলানা আকরম খাঁ এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ করলেন।

ভারতবর্ষ ভাগের এই ফর্মুলা নিয়ে শেখ মুজিব নিজেও বেশ হতাশ হয়েছিলেন। এ বিষয়টি তার আত্মজীবনীতেও ফুটে উঠে।

শেখ মুজিব লিখেছেন, “কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি করতে শুরু করলো। আমরাও বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না, এর জন্য সভা করতে শুরু করলাম। আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এ ভাগের ফর্মুলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না।”

এই অঞ্চলের নেতাদের ধারণা ছিল সমগ্র বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে।

কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের নেতাদের পাশে বসিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর ভারত ভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন

কিন্তু শেখ মুজিব সহ অন্যরা জনাতে পারলেন, আসামের একটি জেলা, যেটি বর্তমানে সিলেট, পাকিস্তানের আওতায় আসবে যদি তারা সেটা গণভোটে জিততে পারে।

শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “গোপনে গোপনে কলকাতার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল, যা হয় হবে, কলকাতা ছাড়া যাবে না। শহীদ সাহেবের (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে। দিল্লি বসে অনেক পূর্বেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে একথা তো আমরা জানতামও না, বুঝতামও না।”

এ সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণ শংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলোচনা সভা করেন। তাঁদের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা যায় কি-না? বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতারা একটা ফর্মুলা ঠিক করেন।

ঐ ফর্মুলায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ হবে স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। শেখ মুজিবের বর্ণনা অনুযায়ী, ঐ গণপরিষদ ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে সেটি নির্ধারিত হবার বিষয়টি ফর্মুলায় উল্লেখ করা হয়েছিল।

এ ফর্মুলা নিয়ে শরৎ বসু গান্ধীর সাথে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করতে যান।

শরৎ বসুকে উদ্ধৃত করে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, এ ফর্মুলা নিয়ে মি. জিন্নাহর কোন আপত্তি ছিলনা, যদি কংগ্রেস রাজী হয়।

ভারতের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর ভারতভাগের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন

অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছিল, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোন ফর্মুলা মানতে পারবে না।

ঐ ফর্মুলা নিয়ে শরৎ বসু কংগ্রেস নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফেরত এসেছিলেন বলে উল্লেখ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেছিলেন, “শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।”

কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ না হওয়ায় গভীর হতাশা তৈরি হয়েছিল শেখ মুজিবের মনে। এজন্য তিনি তখনকার মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একটি অংশকে দায়ী করেন।

শেখ মুজিব লিখেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল।

বিশেষ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যাতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, সেজন্য তাঁর বিরুদ্ধ এক ধরণের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

মি. সোহরাওয়ার্দীকে সরিয়ে খাজা নাজিমউদ্দিনকে ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল।

কিন্তু কেন এ ষড়যন্ত্র হয়েছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান

শেখ মুজিবের বর্ণনা ছিল এ রকম, “বাংলাদেশ ভাগ হলেও আমরা যতটুকু পাই, তাতেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মিলিত লোকসংখ্যার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশী। সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও কর্মক্ষমতা অনেককেই বিচলিত করে তুলেছিল। কারণ, ভবিষ্যতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন এবং বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না।”

এক পর্যায়ে খাজা নাজিমুদ্দিন নেতা নির্বাচিত হলেন। নেতা হয়ে তিনি ঘোষণা করেন যে ঢাকা রাজধানী হবে। মি. নাজিমুদ্দিন দলবলসহ তখন ঢাকায় চলে আসেন।

মি. নাজিমুদ্দিনের ঢাকায় চলে আসার সাথে সাথে কলকাতার উপর থেকে পাকিস্তানের দাবী আর থাকল না বলে উল্লেখ করেন শেখ মুজিব।

লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বই ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’ উদ্ধৃত করে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “ইংরেজরা তখনো ঠিক করে নাই কলকাতা পাকিস্তানে আসবে, না হিন্দুস্তানে থাকবে। আর যদি কোন উপায় না থাকে তবে একে ‘ফ্রি শহর’ করা যায় কি-না? কারণ, কলকাতার হিন্দু মুসলমান লড়বার জন্য প্রস্তুত। যে কোন সময় দাঙ্গাহাঙ্গামা ভীষণ রূপ নিতে পারে। কলকাতা হিন্দুস্তানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল। হিন্দুরা কলকাতা পাবার জন্য আরো অনেক কিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হত।”

শেখ মুজিব লিখেছেন, যখন গোলমালের কোন সম্ভাবনা থাকল না, তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন সে সুযোগে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশী ছিল। কিন্তু তারপরেও কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ভারতকে দেয়া হলো।

কলকাতা পাকিস্তানের অংশ না হওয়াতে হতাশ হয়েছিলেন শেখ মুজিব

তিনি আরও লিখেছেন, মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশী হলেও সেটা ভারতের অংশে দেয়া হলো। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান হওয়ায় তার আধা অংশ কেটে দেয়া হলো। দিনাজপুরে মুসলমান বেশী ছিল। বালুরঘাট মহকুমা কেটে দেয়া হলো, যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং ভারতের অংশ হয়।

শেখ মুজিব মনে করেন, এ জায়গাগুলো কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারতো না।

তাঁর আশা ভঙ্গের বর্ণনা করে শেখ মুজিব লিখেছেন, “যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল, সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়। অথবা পূর্বেই গোপনে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন।

“সোহরাওয়ার্দী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হত, তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল। কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতায় করতে বাধ্য হত, কারণ পূর্ব বাংলার লোকেরা দাবী করত পাকিস্তানের জনসংখ্যায়ও তারা বেশী, আর শহর হিসেবে তদানীন্তন ভারত বর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতা।”

কলকাতা ‘হাতছাড়া’ হওয়ার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়।”

{এই লেখাটির পুরো অংশ শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বই থেকে নেয়া হয়েছে।}

ভারতকে ভেঙ্গে দুটো দেশ গঠনের আগে সংঘটিত দাঙ্গায় অনেক শহরে বহু মানুষ প্রাণ হারায়

সূত্র : ভারতভাগের নাটকীয় ঘটনাবলী, তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের বয়ানে  [বিবিসি বাংলা, ১৪ আগস্ট ২০১৭]

Similar Posts

error: Content is protected !!