অনুপম মাহমুদ ।।
পঁচাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায় তৈরি করেছিলো কারা? কাদের হাতে আজো অরক্ষিত আমাদের সোনার বাংলা? তখনকার পত্র পত্রিকা দেখলেই বোঝা যাবে কারা অজনপ্রিয় করে তুলেছিলেন জাতির পিতাকে। যুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশ যেখানে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিলো, সেখানে গঠনমূলক সমালোচনা না করে বরং কিভাবে তা বাধাগ্রস্থ্য করা যায় তাতেই ব্যতিব্যস্ত্য ছিলেন অনেকেই। খুব আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করি সেদিনের বর্ণচোরার দল কিভাবে ভোল পাল্টে এখন ব্যাপক মুজিব ভক্ত!
একটা তথ্য আমাকে ভীষণ আলোড়িত করে, যখন শুনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ হয়েছিলো আমার প্রাণের শহর কিশোরগঞ্জে। এতে আমার গর্বিত হবার যথেষ্ঠ কারন আছে। সেদিন আসলে কি হয়েছিলো, সেটা নিয়ে কিছু আত্নপ্রচারকারী নিজেদের লাইম লাইটে নিয়ে আসার জন্য বেছে নিয়েছেন সেই মিডিয়াকে। আর আমাদের সম্মানিত সংবাদ কর্মীবৃন্দ সেই সেই তথ্য একটু উনিশ বিশ করে তা প্রচার করে যাচ্ছেন ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো। আগামীর বিশ্ব হবে তথ্যপূর্ণ। যার কাছে যত তথ্য, সে তত স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু ভুল বা আংশিক তথ্য আমাদের ভীতকে করে তুলবে দুর্বল!
তথ্য কখনো কখনো সন্ত্রাসের চেয়েও মারাত্নক হতে পারে। এই ধরুন শাহবাগে গড়ে উঠা তারুণ্যের জাগরণকে সেদিন একটি পত্রিকা সচতুর ভাবেই “নাস্তিকদের” আয়োজন বলে যে প্রপাগান্ডা শুরু করেছিলো, তার দায় এখনো ব্লগাররা রক্ত দিয়েই শোধ করছে। ইতিমধ্যে অনেকেই মৃত্যুকে বরণ করেছেন, অনেকেই হয়েছেন রক্তাক্ত ও দেশান্তরী। এটাই কি ছিলো সেক্যুলার আর ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? যদি রাষ্ট্র হিসেবে আমরা ধর্মীয় আবরনেই নিজেদের প্রকাশ করবো, তাহলে পাকিস্থানের সাথে থেকে গেলে সমস্যা কি ছিলো?
ইদানিং ৭৫ এর প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা খুব শোনা যাচ্ছে। অনেক সত্য ইতিহাস আছে, যা আমরা জানি না। জাতি হিসেবে এ বড় লজ্জার কথা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (ভিন্ন দল করলেও) সেদিন চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমর্থন পাননি বিশেষ করে যাদের কাছে তা পাওনা ছিলো। এদেশীয় বেঈমানেরা সেদিন সহযোগিতা তো দূরের কথা বরং ভন্ডূল করে দিয়েছেন অনেকের প্রচেষ্টা, তাই দেশান্তরী হয়েছিলেন। সেদিন জার্মানিতে থাকা জাতির পিতার কন্যাকে (শোকাতর শেখ হাসিনা নিজেই জানিয়েছেন এই তথ্য) পর্যন্ত সেখানকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তার বাসভবন থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন…
শহীদ শেখ মনির (যুব লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধের অত্যতম প্রধান সংগঠক) পুত্র ব্যারিষ্টার ফজলে নূর তাপস বলছিলেন কিভাবে পালিয়ে বেঁচেছেন। কিভাবে তাকে দাদী সহ ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল টাকার লোভে আমদের মতোই কেউ কেউ। দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন ১৯৭৯ সালে, স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই স্কুল তাকে ছেড়ে যেতে বলা হয়েছিলো। যার যায়, সে বোঝে…
সেদিন জাতির পিতার মন্ত্রী সভার অনেকেই খুনি মোস্তাকের মত্রীসভায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন, আর কথা না শোনায় প্রাণ গিয়েছিলো জাতীয় চার নেতার। এতেই স্পষ্ট কতোটা আমরা মুজিব ভক্ত! আমাদের সংখ্যা কতোটা কম…
সেদিন বাম ঘরানার রাজনৈতিকেরা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধু কে কটাক্ষ করতো, বাধার দেয়াল তৈরি করতো। তাদের অনেকেই আজো বহাল তবিয়তে আমাদের নসিহত করে যাচ্ছেন, আমরাও শুনে যাচ্ছি, কারন আমাদের অসভ্য হতে শিক্ষা দেননি আমাদের বাবা মা। মিথ্যা বলতে উৎসাহ তো দূরের কথা, পিটিয়ে সাবধান করেছেন। রাজনীতি করতে গিয়ে যে পরিস্থিতির শিকার আমরা হয়েছিলাম, সেই জ্বালা আমাদের আছে। আমরা জিয়া এরশাদের সাথে আপোষ করি নাই, তাই কিশোরগঞ্জে তাদের সরকারের আমলে বারবার নিগ্রহের শিকার হয়েছি।
১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পরবর্তী প্রজন্ম আমি। দেশব্যাপী যখন অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চলছিলো, তখন অনেককেই গ্রেফতার করে “রাজবন্দী” করা হয়। উল্লেখ্য তারা কোন মামলার আসামী ছিলেন না, বরং রাষ্ট্রের জন্য হুমকি বিধায় তাদের পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছিলো। আমার বাবা তাদেরই একজন।
প্রথমে কিশোরগঞ্জ, তার পর ময়মনসিংহ কারাগারে ছিলেন, সান্নিধ্য পেয়েছিলেন জাতীয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন তাদের কেউ কেউ, মুজিব বাহিনী তাদের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছিলো। তিন দিন বা তিন ঘন্টার প্রশিক্ষণ নিয়েও অনেকেই যুদ্ধে গিয়েছেন, মরণপণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘ হতে পারে আশঙ্কায় পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই গঠন করা হয়েছিলো “মুজিব বাহিনী”। তাদের দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো ভারতের দেরাদূনে। মুজিব বাহিনীর একজন কমান্ডার আমার বাবা…
৭৫ উত্তর দেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো এই মুজিব প্রেমিকেরাই, যারা হাততালি দিয়েছিলেন, মাটির খাঁচা নিয়া খাল খননে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের টাইম লাইনে গিয়ে দেখুন, তাদের আপডেট! তারা কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে বসে আছেন পান্থকুঞ্জে, কল্পনার নৌকায় চেপে বন্যা বিলাসে ক্লান্ত! কাঁদা পানিতে ওদের অরুচি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ না হলে অনুজ্জ্বল বদন… তারাই করেছিলো সেদিন প্রতিবাদ? তাদের কেউ কেউ সেদিন হাফপ্যান্ট পড়া নাবালক, কেউ কেউ সদূর ঢাকায়… তারা নাকি মিছিল করে ক্লান্ত দেহের অবসাদ দূর করতে “চা পান” করতে বসেছিলেন। তখন পুলিশ তাদের গ্রেফতার (কেমনে জানলো তাদের গ্রেফতার করা হবে?) করতে ধাওয়া দিলে পালিয়ে যায়… তাদের জন্য এই পংতিমালা ধার করেছি “অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির – ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর ”
কাদের গ্রেফতার করা হবে আর হয়েছিলো, তার তালিকা ছিলো স্থানীয় থানায়, খোঁজ নিয়ে দেখুন, কাদের খুনি সরকার গ্রেফতার করেছিলো? কেন করেছিলো? কি ছিলো তাদের অপরাধ? তারা কারা? তাদের কতজন এখন জীবিত? মৃত ও প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রতিযোগীতায় নেমেছেন? একজন মৃত বঙ্গবন্ধুকে দেখেও আপনাদের শিক্ষা হয়না? চেতনা ও ইতিহাস আরোপ করা যায় না, এটা প্রতিটি মানুষের অস্থি মজ্জায় স্থাপিত। আমরা কিছু বলি না মানেই আপনাদের এই সব ছেলেমানুষি দেখি বিরক্ত নই, তা কিন্তু না। আমরা চাই ইতিহাস যেন বিকৃত না হয়। যার যা প্রাপ্য সম্মান তাকে তা দিতে আমাদের কার্পণ্য থাকার কথা নয়। অবদান থাকলে আপনে কুর্নিশ জানাবো…
সত্য হলো এইঃ কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের (জাতীয় ছাত্রলীগ) তৎকালীন সেক্রেটারি জনাব সাব্বির আহাম্মেদ মোস্তফা মানিক, নিকলি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী, গোলাম রাব্বানি বুলবুল, জনাব মতিউর রাহমান এড, গোলাম রাব্বানি মুক্তু, জনাব আনোয়ার কামাল এবং আরও কয়েকজন সকাল ৭টার দিকে কিশোরগঞ্জ শহরের আখড়া বাজার আমার বাসার সামনে থেকে প্রথম প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি পুরানথানার দিকে অগ্রসর হলে, সেখানে পুলিশের বাধার মুখে, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান এবং পরবর্তীতে তখনকার তাড়াইল-করিমগঞ্জের এমপি জনাব আব্দুল কুদ্দুস সাহেবের বাসায় সবাই মিলিত হন। ঐখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন, কিশোরগঞ্জ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আশরাফ উদ্দিন মাস্টার ও করিমগঞ্জ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব কুদ্দুস সাহেব, বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুল হামিদ সাহেব ও মহিউদ্দীন সাহেব। এরপরের ঘটনাপ্রবাহ প্রায় সবারই জানা। ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট সৃষ্টিকারী, চা বিলাসী সৈনিকরা, আলোচনায় আসে কিভাবে? প্রশ্নটা করেছেন Nur Ahmed Palash ভাই…
সাবেক প্রচার সম্পাদক ও সুদীর্ঘ সময় যুব লীগের কাণ্ডারি নগুয়ার আনোয়ার কামাল চাচা হচ্ছেন কিশোরগঞ্জের প্রথম রাজবন্দী, আর কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ এর বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক জনাব সাব্বির আহাম্মেদ মোস্তফা মানিক কাকা ফেরারী হয়ে কাটিয়েছেন সুদীর্ঘ রজনী, মানিক কাকাকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষনা করেছিলেন খুনি সরকার। গত কয়েক বছরের প্রপাগান্ডা ও একই নিউজ বারবার করায় এই প্রতিবাদ করতে বাধ্যই হলাম। সংবাদ কর্মী ও কিশোরগঞ্জের সচেতন নাগরিকদের কাছে আমার অনুরোধ কামাল চাচা ও মানিক চাচা এখনো জীবিত আছেন, তাদের সাথে কথা বলুন সত্য জানুন। আমরা ইতিহাসের সুন্দর আগামী দেখতে চাই, ভ্রাতি বিলাস আর কতদিন?
একটা ঘটনা বলে শেষ করছি, গতকাল শোক র্যালী নিয়ে যখন রাসেল স্কোয়ারে তখন পান্থপথে একটা এক্সপ্লোশন হয় ব্যাপক শব্দে, আমাদের খুব কাছেই, আমরা দেয়াল ধ্বস ও ধুলোর কুণ্ডলী দেখেছি সামনে থেকেই, পুলিশ আমাদের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছিলো। লোকজন পালাচ্ছিলো দিক্বিদিক, চিৎকার করে বললাম, কিচ্ছু হয়নি, কেউ দৌড়াবেন না, আরো কয়েকজন সমর্থন করলো, তা না হলে পদপিষ্ঠ হয়ে হতাহত হতেই পারতো অনেক। একজন তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন আমার কাছে। কানে কানে বললেনঃ বেশ বড় এক্সপ্লোশন হয়েছে, হতাহত হবার সম্বাবনা আছে প্রবল, ভয় পাননি? আমি উত্তর দিয়েছিলাম ভয় পেলে এখানে আসতাম?
তাই আবারো বলছি… অসত্যের কাছে নত নাহি হবে শির – ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর…
লেখক : মানবাধিকার কর্মী