আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
তুরস্ক সরকারের অনুরোধে তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান লেখক ডোগান আকানলি স্পেনে গ্রেফতার হওয়ায় চলছে সমালোচনা। প্রশ্ন উঠছে, কারা চালায় ইন্টারপোল? কিভাবেই বা নির্ধারণ হয় এই আন্তর্জাতিক সংস্থার কাজ? কিভাবে নিশ্চিত হয় জবাবদিহিতা?
একটা সময় ছিল, যখন বড় ধরনের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া ছিল খুব সহজ। অপরাধীরা দেশের সীমানা পেরিয়ে গেলেই তাদের আর আটক বা গ্রেফতারের সুযোগ থাকতো না সেদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। এই সুযোগ বেশ ভালোই কাজে লাগাচ্ছিল বিভিন্ন মাফিয়া চক্র।
বারবার এভাবে অপরাধীদের কাছে পরাজিত হওয়ার হতাশা থেকেই চিন্তা আসে একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গড়ে তোলার। ১৯১৪ সালে মোনাকোতে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ জুডিশিয়াল পুলিশের প্রথম বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। এই সমস্যাকে বৈশ্বিকভাবে মোকাবেলা করার ব্যাপারে বৈঠকে একমত হন অংশগ্রহণকারীরা। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধীদের দমন করা হবে আন্তর্জাতিকভাবেই।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এই উদ্যোগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিকে দীর্ঘায়িত করে। কিন্তু ১৯২৩ সালে সংস্থাটির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভিয়েনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ কমিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে এই সংস্থারই নামকরণ হয় ইন্টারপোল।
কিন্তু সংস্থাটির কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর এর তেমন কর্তৃত্বও ছিল না। শুধু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাই ছিল এর প্রধান কাজ।
ইন্টারপোলের কাজের ধরন
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বা দেশগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক বিষয়ে যাতে ইন্টারপোল নাক না গলাতে পারে, সেজন্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিতে বলা হয়, এই সংস্থা ‘রাজনৈতিক, সেনা সম্পর্কিত, ধর্মীয় ও জাতিগত’ বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে। মূলত জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ, মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি, দুর্নীতির মতো অপরাধ নিয়েই কাজ করে ইন্টারপোল।
ইন্টারপোলের সদরদপ্তর এখন ফ্রান্সের লিওঁতে। সংস্থাটির বার্ষিক বাজেট প্রায় ৭৮ মিলিয়ন ইউরো বা ৭০ কোটি টাকা। এই বাজেটের অর্থ আসে এর ১৯০টি সদস্য রাষ্ট্রের বার্ষিক অনুদান থেকে। ইন্টারপোলের নিজস্ব কর্মকর্তা আছেন মাত্র সাড়ে ছয়শ’র কাছাকাছি। এদের সবাই বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মচারি ও পুলিশ কর্মকর্তা।
অপব্যবহার
অপরাধীদের অপরাধ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করতে নানা রঙের নোটিশ ব্যবহার করে থাকে ইন্টারপোল। সবচেয়ে বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় রেড নোটিশকে। রেড নোটিশকে এই সংস্থাটির আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ব্যবস্থায় মুহূর্তের মধ্যে ১৯০ সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশের কাছে চলে যায় অপরাধীদের অপরাধ, সর্বশেষ অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য।
পালিয়ে বেড়ানো অপরাধীদের ধরতে এই ব্যবস্থা খুব কার্যকর বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও, আছে বিপরীত ঘটনাও। ইউরোপিয়ান কমিশন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগ, নানা সময়েই বিভিন্ন স্বৈরাচারী সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যবহার করেছে ইন্টারপোলের এই রেড নোটিশ। ইন্টারপোলও কোনোপ্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সে নোটিশ জারি করে দেয়।
নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানিতেও অনেকবার ইন্টারপোলের রেড নোটিশ কাজে লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বেসরকারি সংগঠন ‘ফেয়ার ট্রায়ালস’-এর ক্যাম্পেইন ও কমিউনিকেশন ম্যানেজার অ্যালেক্স মিক। ডয়চে ভেলেকে পাঠানো এক ই-মেলে তিনি বলেন, ‘‘অপরাধ দমনে ইন্টারপোলের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গুরুতর অপরাধীদের ধরতে কাজে লাগানোর বদলে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই রেড নোটিশকে কাজে লাগিয়েছে শরণার্থী, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের ধরতে। কোনো কোনো শাসক সমালোচকদের চুপ করাতেও সুযোগের অপব্যবহার করেছেন।”
ফলে অনেকক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অযৌক্তিক প্রমাণের আগেই তাদের মাসের পর মাস কাটাতে হয়েছে কারাগারে।
সূত্র : কে চালায় ইন্টারপোল? [ডয়চে ভেলে, ২২ আগস্ট ২০১৭]