আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
জার্মানিতে ‘বিও’, মানে ‘বায়োলজিক্যাল’ বা অরগ্যানিক পণ্যের চাহিদা বেড়ে চলেছে, অথচ উৎপাদন সেই অনুপাতে বাড়ছে না; সাথে রয়েছে পরিবেশ ও পশুকল্যাণ সংক্রান্ত নানা সমস্যা। ‘বিও’ তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে একটি সুযোগ হতে পারে।
কর্তা খান চালভাজা, গিন্নি খান ‘বিও’– এ কাহিনী জার্মানির ঘরে ঘরে। জার্মানির শহরে শহরে আজ ‘বিও’, অর্থাৎ অরগ্যানিক খাবার-দাবার ও অন্যান্য নানা ধরনের ‘বিও’ পণ্যের দোকান। সুপারমার্কেটগুলোতেও আজকাল ‘বিও’ পণ্যের আলাদা এলাকা থাকে, নয়ত প্রথাগত পণ্যের মধ্যেই ‘বিও’ তকমা-মারা পণ্যগুলি শোভা পায়। দামে এককালে বিপুল ফারাক ছিল, সাম্প্রতিককালে ‘বিও’ পণ্যের দাম কমতে কমতে– ও প্রথাগত পণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে– প্রায় একই পর্যায়ে চলে এসেছে।
‘বিও’ বা অরগ্যানিক বলতে যে কী বোঝায়, তা ব্যাখ্যা করতে গেলে ব্লগ নয়, বই লিখতে হবে। বার্লিনের তরুণ সমাজে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, উঠতি গ্রাহকদের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বিও’ হলো একাধারে একটা ফ্যাশন, একটা আদর্শ ও একটা জীবনদর্শন। অর্থনীতি-রাজনীতি-পরিবেশ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ‘বিও’ অনুরাগীদের মনোভাব যে কী হবে, তা যেন আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়। এ তো গেল ‘বিও’-র তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক দিক।
‘বিও’-র দ্বিতীয় পর্যায় হলো ইউরোপের ‘কৃষি শিল্প’, যা শিল্পায়ন, আধুনিকীকরণ ও উৎপাদনশীলতার চরম শিখরে উঠে হঠাৎ দেখছে যে, গ্রাহকরা বেঁকে বসেছেন, তারা আর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, পক্ষান্তরে অ্যান্টিবায়োটিক্স দূষিত খাদ্য গ্রহণ করতে চান না। আবার কৃষিজীবীদের মধ্যেও আদর্শবাদী আছেন ও চিরকালই ছিলেন : জার্মানিতে ‘বিও’ আন্দোলনের সূচনা বস্তুত ১৯২৪ সালে। কাজেই জার্মানির মতো সমৃদ্ধ ও সুসংগঠিত দেশে যে জনজীবন থেকে শুরু করে সুপারমার্কেট অবধি একটা ‘বিও’ প্রবণতা শীঘ্রই দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না।
‘বিও’-র তৃতীয় পর্যায়ে আসছে নিয়ন্ত্রণ, অর্থাৎ সরকার ও ইইউ-এর আমলাদের টনক নড়া। প্রক্রিয়াটা এক হিসেবে সাম্প্রতিক, কেননা জার্মানির অরগ্যানিক ফার্মিং অ্যাক্ট গেজেটে বেরোয় ২০০২ সালে; অরগ্যানিক ফার্মিং সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মাবলী প্রকাশিত হতে হতে ২০০৭ সাল হয়ে যায়– কাজেই জার্মান সরকারকে ২০১২ সালে তাদের অরগ্যানিক ফার্মিং অ্যাক্টে কিছু কিছু রদবদল করে সেটাকে ইইউ-এর অরগ্যানিক নীতিমালার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।
চাহিদা বেশি, উৎপাদন কম
ইইউ-তে ‘বিও’ পণ্যের চাহিদা জার্মানিতেই সবচেয়ে বেশি। বলতে কি, এক্ষেত্রে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই জার্মানিকে ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া জার্মানিতে ‘বিও’ পণ্যের চাহিদা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ২০১৬ সালে জার্মানিতে ‘বিও’ খাদ্যপণ্যের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ– যদিও তা খাদ্যপণ্যের মোট বিক্রির মাত্র পাঁচ শতাংশ।
উৎপাদনের ক্ষেত্রে চিত্র অনুরূপ আশাব্যঞ্জক নয়। জার্মান খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল অবধি জার্মানির মোট চাষ-আবাদ করা জমির মধ্যে অরগ্যানিক ফার্মিং-এর অনুপাত ২ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে; অরগ্যানিক খামারগুলির মোট সংখ্যায় কৃষিখামারের অনুপাত ১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। উৎপাদনের এই শম্বুকগতিতে বৃদ্ধি বছরে আট থেকে দশ শতাংশ হারে বেড়ে চলা চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। কাজেই ‘বিও’-র ব্যাপারিদের একমাত্র উপায় হলো বিদেশ থেকে আমদানি।
বিদেশ থেকে আমদানি বলতে বোঝায় একদিকে ইইউ-এর অভ্যন্তরে পণ্যের আদানপ্রদান; অন্যদিকে দক্ষিণ অ্যামেরিকা, আফ্রিকা বা এশিয়া থেকে ‘বিও’ পণ্য আমদানি। বিশেষ করে ফলমূলের ক্ষেত্রে ধনি দেশ জার্মানির গ্রাহকরা যে কোনো মরশুমে তাদের প্রিয় ফলটি পেতে ও খেতে অভ্যস্ত, তা সে ব্রাজিলের কলা হোক আর নিউজিল্যান্ডের কিউয়ি ফল হোক। এর ভালো-মন্দ দু’টো দিকই আছে।
প্রথমত, জার্মানিতে ‘বিও’ খাদ্যের বিপুল চাহিদার ফলে পোল্যান্ড, চেক গণরাজ্য, অস্ট্রিয়া এমনকি ফ্রান্স ও সুদূর স্পেনের খামারচাষিরাও ‘বিও’ বিজনেসের গন্ধ পেয়েছেন ও তা থেকে মুনাফা করছেন। অপরদিকে, দূর দূর থেকে পণ্য পরিবহণের অর্থ ‘বিও’ পণ্যের কার্বন ফুটপ্রিন্ট ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, জার্মানির আদর্শবাদী ‘বিও’ গ্রাহকদের যা পছন্দ হওয়ার কথা নয়– ট্রাকে করে গ্রীষ্মের দাবদাহে জীবন্ত জন্তুজানোয়ারদের ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাঠানোর কথাটা না হয় আপাতত বাদই থাকল।
নতুন হিসেব
কাজেই জার্মানির সুপারমার্কেটগুলি ক্রমেই ‘বিও’-র পাশাপাশি ‘স্থানীয় পণ্য’ রাখতে শুরু করেছে; অর্থাৎ স্পেন থেকে আসা ‘বিও’ টমেটোর পাশেই বনের কাছে ওয়েসেলিং থেকে আসা টমেটো। এই ‘স্থানীয় পণ্য’ তকমাটির বক্তব্য হলো, ‘আমি টাটকা ও আমার কার্বন পদাঙ্ক বলিরাজার মতো সুবিশাল নয়।’
আমরা দেখেছি যে, ‘বিও’ বিজনেস বেড়ে বিগ বিজনেস হওয়ার পথে। গ্রাহকদের জন্য এর সুবিধে, ‘বিও’ পণ্যের দাম পড়ছে। অপরদিকে জার্মানির ‘বিও’ খামারচাষিরা দেখছেন যে, তাদের লাভের মার্জিন বা অনুপাত কমে আসছে, অপরদিকে ‘বিও’ চাষে ফসল কম, ল্যাটা বেশি। কাজেই বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের নীতি অনুযায়ী ‘বিও’ উৎপাদন এখন ইউরোপ তথা বিশ্বের সেই সব দেশে যাচ্ছে, যেখানে শ্রমের মূল্য অপেক্ষাকৃত কম। তৃতীয় বিশ্বের সুযোগ এখানেই।
ইতিমধ্যেই আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চীন, ভারত ও পেরুর মতো দেশে অরগ্যানিক ফার্মিং বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এরা পথিকৃৎ, কিন্তু পরে অন্যান্য দেশেরও এই সুযোগ আসবে। তৃতীয় বিশ্ব থেকে আগত ‘বিও’ পণ্যের কার্বন ফুটপ্রিন্ট নিয়ে বিতর্ক ভবিষ্যতেও ঠিক তেমনিভাবেই চলবে, আজ যেমন গার্মেন্টস শিল্পে ‘ফেয়ার ট্রেড’ নিয়ে বিতর্ক চলেছে। কার্বন ফুটপ্রিন্টের কথা ভেবে কেউ যেরকম তৃতীয় বিশ্বে টুরিজম বন্ধ করার কথা বলবেন না, তেমনই এই ‘বিও’ আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলিকে একাধারে উন্নয়ন ও অপরদিকে পরিবেশ সুরক্ষার পথ খুলে দিতে পারে।
সূত্র : গার্মেন্টসের মতোই অরগ্যানিক ফার্মিং একটি সুযোগ হতে পারে [ডয়চে ভেলে, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭]