মো: আল আমিন ।।
সকাল থেকেই থেমে থেমে হচ্ছিল বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শরতের আকাশের কান্না কিছুটা থামল। নীল রঙ মাখানো আকাশে তখনো কালোর ছোপ। বইছে অল্প অল্প হাওয়া। সে হাওয়া ছোট ছোট ঢেউ তুলেছে হাওরের বুকে। যেন হাওর জুড়ে ছন্দের দুলুনি! এই দুলুনির মধেই পানি কেটে কেটে ছিপছিপে দীঘল নৌকাগুলোর সে কী ছুটে চলা! কে কাকে পেছনে ফেলবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা। নৌকায় দু’পাশে সার বেঁধে বসা মাঝিরা গানের তালে তালে টেনে চলেছেন বৈঠা। নৌকার গলুইয়ে বসা গায়েনের কণ্ঠে দরাজ সুর, …‘আল্লাহ বলিয়া নাও খোলরে ভাই সক্কলে। আল্লাহ বলিয়া নাও খোলো… ওরে আল্লাহ বলিয়া নাও খোলো শয়তান যাবে দূরে। ওরে যে কলমা পইড়া দেছে মুহাম্মদ রাসূলরে ভাই সক্কলে…’। এককটা কলি শেষ হতেই মাঝিদের সমস্বরে চিৎকার ‘হৈ হৈ’। পেছনের নৌকা কাছাকাছি চলে আসছে! গায়েন কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেন। সেই সাথে গানের গতিও বাড়িয়ে দেন। অসম্ভব দ্রুততায় ছুটে চলেছে নৌকা! হাওর পাড়ের হাজার হাজার মানুষ সে দৃশ্য দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। দেহ ও মনের উত্তেজনার বশে তারাও চিৎকার করছেন ‘হৈ হৈ… হৈ হৈ, আগ্গয়া যাও আগ্গয়া যাও’ (এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও)। কিশোরগঞ্জের নিকলীর হাওরে এমনই একটি উৎসবমুখর ও উত্তেজনাকর নৌকা বাইচ হয়ে গেলো বুধবার ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে। সদরের বেড়িবাঁধের সামনে ‘সোয়াইজনী’ নদীতে এবার এ নৌকা বাইচের আয়োজন করে নিকলী নতুন বাজার সার্বিক ব্যবস্থাপনা কমিটি ও বণিক সমিতি। নৌকা বাইচ দেখতে কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও আশপাশের জেলা থেকে লাখো মানুষ উপস্থিত হন।
নিকলীর এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো। আগে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের প্রথম দিন এই নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হতো। কালের বির্বতনে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী অনেক খেলাধুলার মতো নৌকাবাইচও হাওরবাসীর স্মৃতি থেকে মুছে যেতে বসেছিল। গত আট বছর ধরে নিকলী উপজেলা প্রশাসন হাওরে হারানো এই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আশ্বিন মাসের কোনো এক দিন নৌকাবাইচের আয়োজন করত। এবার উপজেলা প্রশাসন এখন পর্যন্ত নৌকা বাইচের আয়োজন না করায় নিকলী নতুন বাজার বণিক সমিতি এই নৌকা বাইচের আয়োজন করে।
ভিডিও সংগ্রহ : ইমরান হোসেন
নৌকাবাইচ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক সদর ইউপির চেয়ারম্যান কারার শাহরিয়ার আহমেদ তুলিপ এবং ওই কমিটির সদস্য সচিব মো: জসিম উদ্দিন জানান, এই একটি দিনের জন্য হাওরবাসী সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বোরো ধান কাটা শেষ হলে শুরু হয়ে যায় নৌকাবাইচের প্রস্ততি। শুরু হয় পুরোনো নৌকা মেরামত ও নতুন ‘দৌড়ের নাও’ তৈরির কাজ।
ইতিহাস
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকাবাইচ লোকায়ত বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। তবে কবে এদেশে গণবিনোদন হিসেবে নৌকাবাইচের প্রচলন হযেছির তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। ‘বাইচ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে অনুমিত হয়েছে যে মধ্যযুগের মুসলমান নবাব, সুবেদার, ভূস্বামীরা, যাদের নৌবাহিনী ছিলো, তারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিনোদনের সূত্রপাত করেছিলেন।
বাইচ শব্দটি ফারসি। এটি ‘বাজি’ শব্দজাত। যার বিবর্তন এরূপ : বাজি>বাইজ>বাইচ। এর অর্থ খেলা। মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের আমলে নৌকা বাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। এ কারণেও অনেকে মনে করেন, নবাব বাদশাহদের নৌ বাহিনী থেকেই এ দেশে নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চলের রাজ্য জয় ও রাজ্য রক্ষার অন্যতম কৌশল ছিল নৌ শক্তি। বাংলার বার ভূঁইয়ারা নৌ বলেই মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। মগ ও হার্মাদ জলদস্যুদের দমনে নৌ শক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এসব রণবহর বা নৌবহরে দীর্ঘাকৃতির ছিপ জাতীয় নৌকা থাকত। বর্তমানে বাইচের নৌকার আকৃতিও সে রকমই।
বাংলাদেশের নৌকা বাইচ অনেক প্রাচীন হলেও খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০ বছর আগে ‘মেসোপটেমিয়ার’ লোকেরা ইউফ্রেটিস নদীতে এক ধরনের নৌকা বাইচের আয়োজন করত। এর কয়েক শতাব্দী পর মিসরের নীলনদের জলে নৌকা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর পর ছড়িয়ে পড়তে থাকে এর প্রসার। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়। ১৯০০ সাল থেকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৩৫টি ফাইনাল হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ বার যুক্তরাষ্ট্র, ২৫ বার জার্মানি ও ১৪ বার যুক্তরাজ্য বিজয়ী হয়।
বাইচের নৌকার গঠন
বাইচের নৌকার গঠন কিছুটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই নৌকা হয় ছিপছিপে ধরনের। চওড়ায় খুব সরু ও বেশ লম্বাটে। এ কারণে এ নৌকা নদীর পানি কেটে তরতরিয়ে দ্রুতত চলতে সম এবং প্রতিযোগিতার উপযোগী। নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। তাতে কখনো করা হয় ময়ুরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্য কোনো পাখির মুখাবয়ব। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয়। সর্বোপরি নৌকাটিকে দর্শকের সামনে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা থাকে। এককটা নৌকা লম্বায় ১০০ ফুট থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে নৌকার কিছুটা পার্থক্যও দেখা যায়।
ঢাকা, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ এ অঞ্চলগুলোতে বাইচের জন্য সাধারণত কোশা আকৃতির নৌকা ব্যবহৃত হয়। এ নৌকার সামনের ও পেছনের অংশ থাকে একেবারে সোজা। কোশা নৌকা তৈরিতে শাল, শীল কড়ই, চাম্বুল ইত্যাদি গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। টাঙ্গাইল ও পাবনার বাইচের নৌকার সামনের দিকটা পানির সাথে মিশে থাকে আর পেছনের অংশটি পানি থেকে প্রায় ৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। এই নৌকায় সামনের ও পেছনের মাথায় চুমকির বিভিন্ন কারুকার্য থাকে। নৌকাগুলো তৈরিতে সাধারণত শাল, গর্জন, শীল কড়ই, চাম্বুল ইত্যাদি গাছের কাঠ ব্যবহৃত হয়। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আজমিরিগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে বাইচের জন্য সারেঙ্গী নৌকা ব্যবহৃত হয়। এর আকারও কোশা ও ছিপ জাতীয় নৌকার মতই সরু। লম্বায়ও প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট তবে এর প্রস্থ একটু বেশি হয়। এ অঞ্চলের নৌকার সামনের ও পেছনের দিকটা পানি থেকে দু-তিন ফুট উঁচু থাকে এবং মুখটা হাঁসের মুখের মতো চ্যাপ্টা হয়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালি জেলার নিম্নাঞ্চল ও সন্দ্বীপে বাইচের জন্য সাম্পান ব্যবহৃত হয়। সাম্পান দেখতে জাহাজের মতো। ঢাকা ফরিদপুরে ব্যবহৃত হয় গয়না নৌকা। বাইচের জন্য বিশেষভাবে তৈরি গয়নার দৈর্ঘ্যে সাধারণ গয়নার চেয়ে বেশি হয়।
বাইচের নৌকাগুলোর বিভিন্ন নামও থাকে। যেমন, অগ্রদূত, ঝরের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুম, তুফান মেল, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি।
বাইচের নিয়ম বা আনুষ্ঠানিকতা
নৌকা বাইচের আনুষ্ঠানিকতাও চমৎকার। নৌকায় ওঠার আগে সকলে পাক-পবিত্র হয়ে গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেধে নেয়। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার নির্দেশক। দাঁড়িয়ে থেকে নৌকা চালান পেছনের মাঝিরা। অন্য মাঝিরা নৌকার দুই পাশে সার বেধে বসে একত্রে জয়ধ্বনিসহ বৈঠা টানে। প্রতিটি নৌকায় ২৫, ৫০ বা ১০০ জন মাঝি থাকতে পারেন।
মাঝিদের বৈঠা টানাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য একজন পরিচালক থাকে যাকে বলা হয় গায়েন। সে বসবে নৌকার গলুই-এ। গায়েনের নির্দেশে মাঝিরা একত্রে গান গাইতে আরম্ভ করে এবং সেই গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানে ; যার ফলে কারও বৈঠা ঠোকাঠুকি না-লেগে এক সাথে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন কাঁসির শব্দে এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় প্রয়োজনবোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয় এবং সেই সাথে গানের গতিও বেড়ে চলে। বাইচের নৌকায় সারিবদ্ধভাবে বসে মাঝিরা গায় বলে এ গানকে সারি গান বলা হয়।
আবহমানকাল থেকে বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নৌকা বাইচ এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এর কারণ বিভিন্নভাবে নদী দখল ও কল কারখানার বর্জ্যের মাধ্যমে নদীকে মেরে ফেলেছি আমরাই। নষ্ট করে ফেলেছি নদীর পানি। নদী হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক গতি। ফলে পানি শুকিয়ে এমনিতেই হারিয়ে যাচ্ছে নদী সেই নাথে নৌকা বাইচ। এ অবস্থায় হাওর অঞ্চলের টিকে থাকা নৌকা বাইচ আমাদেরকে আন্দোলিত করে। প্রশাসন ও ক্রীড়ামোদীরা এগিয়ে এলে আবারও আমাদের নৌকা বাইচের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
পুরস্কার বিতরণ
এবারের নিকলীর নৌকা বাইচে দেশের বিভিন্ন এলাকার ১০টি নৌকা অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে নিকলীর গোবিন্দপুরের আলী হোসেনের নৌকা। দ্বিতীয় হয় নিকলী সদরের বর্তমান চেয়ারম্যান কারার শাহরিয়ার আহমেদ তুলিপের নৌকা। তৃতীয় স্থান লাভ করে নিকলীর গুরুই গ্রামের তোতা মিয়ার নৌকা।
অনুষ্ঠানে নিকলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কারার সাইফুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিজয়ী নৌকার মালিকদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।