সাদিয়া ইসলাম ।।
পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী তার ছোটবেলাতেই মাদরাসাকে বেছে নিতে হয়েছিলো শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে। এরপর? এরপরের গল্পটা একেবারেই অন্যরকম। প্রথমে চক, তারপর পেন্সিল, ধীরে ধীরে তুলি আর জলরঙ, আর এখন ইলাস্ট্রেটর আর ফটোশপ দিয়ে নিজের সৃষ্টিকর্মে ঝড় তুলে চলেছেন শোলাকিয়ার শাকীর এহসানুল্লাহ।
আঁকাআঁকির শুরুটা সেই ৫/৬ বছর বয়স থেকেই। ঘরের ফ্লোরে চক দিয়ে আঁকতে আঁকতে একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক দেয়ালিকাতে আঁকতে শুরু করেন শাকীর। দিন যত গড়াল তার আঁকার নেশাও তত তীব্র হতে লাগলো। পরিবার থেকে খুব যে সমর্থন পেয়েছেন শাকীর তা না। তবু জানার আগ্রহ থেকেই পরিচিতজনদের বিভিন্ন দোকানের কম্পিউটারে টুকটাক গুঁতাগুঁতির শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মাদরাসায় পড়াশোনা শেষ করে নিজের মতো করে চাকরিতে ঢুকে যান। কয়েক বছরের মধ্যেই মানুষের নজরে চলে আসেন এই শিল্পী। কবি আহমেদ তানভীরের কবিতার বই ‘জীবনগাঙের পরানকথা’ দিয়ে প্রচ্ছদ করা শুরু হলেও এখন তার নাম ছড়িয়ে গেছে সম্পাদক নঈম নিজাম, তসলিমা নাসরিন, ভাস্কর চৌধুরী, রণক ইকরাম, আমিরুল মোমেনীন মানিকসহ অসংখ্য খ্যাতিমান লেখকদের বইয়ের পাতায়। বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করা আর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারসহ বিভিন্ন খ্যাতিমান মানুষের পোট্রেট আঁকা এই মানুষটিকে সবাই এক নামে চেনে। তার আঁকা বাংলাদেশ দলের বিভিন্ন ক্রিকেটারের স্কেচ ছড়িয়ে গেছে মানুষের ফেসবুক ওয়ালে ওয়ালে। এমনকি ক্রিকেটারদের অফিসিয়াল পেজগুলোতেও।
কিন্তু মাদ্রাসাপড়ুয়া শাকীরের মাথায় এই আঁকাআঁকির ভূত চাপলো কী করে? আর সেটার শুরুই বা হল কবে? প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলেন শিল্পী। বললেন, “ছবি আঁকার বিষয়টা ধরতে গেলে আমার বংশগত। আমার চাচা ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ছাত্র। চাচা খুব ভাল আঁকতেন। উনার নাম ছিল নুরুদ্দীন। উনি তখন পড়াশোনা করতেন ময়মনসিংহে। চাচা নানারকম ছবি আঁকতেন আর গ্রামের মানুষ সেগুলো নিয়ে তাদের ঘর বা দোকানে ঝুলিয়ে রাখতো। সেরকম একটা ছবি টাঙ্গানো ছিল এক চায়ের দোকানে। ছবিটা ছিল গোধুলিবেলায় পানিভরা কলসি কাঁধে এক কিশোরী মেয়ের দ্রুত বাড়ি ফেরার দৃশ্য। ঘটনাক্রমে ছবিটা চোখে পড়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের। আর সেখান থেকেই আমার চাচাকে খুঁজে আবিষ্কার করেন তিনি নিজেই। জয়নুল আবেদীন নিজের খরচে ঢাকায় পড়াশোনার অফার দেন চাচাকে। চাচা ঢাকায় আসেন। যদিও শেষে কোনো এক কারণে চাচার বিখ্যাত শিল্পী হয়ে উঠা হয়নি। তবে আমার এই চাচাই আমাকে ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে জুমআ’র পরে আমাদের বাসায় এসে চাচা খবর নিতেন আমি নতুন কী এঁকেছি। আঁকাআঁকির ভেতরে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়ে আমার ১২ বছর বয়সে চাচা মারা যান। আমি থেমে যাইনি। চাচার উৎসাহকে বুকে নিয়ে সব পড়াশোনার ভেতর দিয়ে ঘুরে ফিরে আঁকাআঁকির ভেতরেই ঘুরপাক খেতে শুরু করি। আস্তে আস্তে আঁকাআঁকির প্রতি টান আর ভালোবাসা বাড়তে থাকে। বসে যায় মগজে। পেন্সিল আর কাগজে ঘষতে ঘষতে এখন মাউস আর ইলাস্ট্রেটরে ঘষি। বলতে গেলে ছোটবেলার সেই বদভ্যাসগুলোই এখন আমার যোগ্যতা হয়ে কাজে দিচ্ছে”। অতীতের এসব গল্পের ভেতর দিয়ে নিজের আজকের অবস্থানের পেছনে চাচার অবদানকে এভাবেই স্বীকার করেন শাকীর।
আজকের এই অবস্থানটা অর্জনের জন্যে একসময় তার প্রায় যুদ্ধই করতে হয়েছে। দিনের পর দিন পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে মেতেছেন। কেউ তখন তাকে কিছু উপহার দিতে চাইলে সে সবসময়ই রং পেন্সিল আর আর্ট খাতা চাইতো। যে কারণে অন্যান্য খেলনার প্রতি তার মনোযোগ ছিলো কম। ৭/৮ বছর বয়সে নিজের ভাইবোন ও তাদের বন্ধু-বান্ধুবিসহ অসংখ্য মানুষের প্র্যাক্টিক্যাল খাতা এঁকে দিয়েছেন চকলেটের বিনিময়ে। যদিও এসএসসিতে নিজের প্র্যাক্টিক্যাল খাতাটা ব্যস্ততার কারণে দুই শ’ টাকার বিনিময়ে আরেকজনকে দিয়ে করিয়ে নিতে হয়েছিলো।
এভাবেই সবার সব কথাকে পাশ কাটিয়ে নিজের মতো কাজ করে গেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সাহায্য বা শিক্ষা ছাড়াই ছবি আঁকার মতো বেশ কিছু যোগ্যতা অদ্ভুতভাবে আয়ত্ব করে নিয়েছেন নিজে নিজেই। শেষ পর্যন্ত তার ছোটবেলার নেশাটাই পেশা হয়ে ধরা দিলো হাতের মুঠোয়।
সেই পেশা থেকেই টুকটাক কাজ শুরু করেন নিজের বড় ভাইয়ের পাঞ্জাবীর প্রতিষ্ঠান এরাসপার্কে। তারপর জয়েন করেন সাপ্তাহিক লিখনীতে। সাপ্তাহিক লিখনীতে থেকে নিজের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে নজরে আসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম ও সিনিয়র সাব এডিটর রণক ইকরামের। এভাবেই সুযোগ হয়ে ওঠে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ কাজ করার। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের ফিচার বিভাগে সাব এডিটর হিসেবে কর্মরত থাকার পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ গ্রাফিক্স ডিজাইনসহ ইলাস্ট্রেশনের কাজগুলোও করে যাচ্ছেন নিয়মিত।
সূত্র : ছোটবেলার বদভ্যাসগুলোই এখন আমার পেশা: শাকীর [প্রিয় ডটকম, ২২ জানুয়ারি ২০১৭]