মৃত নরসুন্দা নদী নিকলী দামপাড়ায় এখনো জীবিত

আব্দুল্লাহ আল মহসিন ।।

হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকট মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ দিয়ে ভৈরবে মেঘনায় পতিত হয় ব্রহ্মপুত্র নদ। এটি ময়মনসিংহ থেকে হোসেনপুর, পাকুন্দিয়ার মধ্য দিয়ে এসে পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে একটি আরেকটি নতুন নদী সৃষ্টি করেছে। নতুন সৃষ্টি হওয়া এই নদীটির নামই নরসুন্দা নদী। এটি পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর থেকে প্রবাহিত হয়ে কিশোরগন্জ, তাড়াইল, করিমগন্জ দিয়ে নিকলী দামপাড়ায় এসে সোয়াইজনীর সাথে মিলে ঘোড়াউত্রায় পতিত হয়। এর দৈর্ঘ আয়তন প্রায় ৬০ কিলোমিটার। কিশোরগন্জের ইতিহাস গবেষক ম. আব্দুল লতিফ বলেন, “আজকের কিশোরগন্জ শহরের উৎপত্তি ও বিকাশ এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে”। এক সময় উত্তাল ছিল এই নদী। তাই বলা যায়, কিশোরগন্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে অবদান কম নয় নদীটির।

soaijani

ভাটির রাজা মসনদে আলা বীর ঈশাখা এগারসিন্দুর থেকে জঙ্গলবাড়ীতে নৌবিহারে এসেছিলেন এর উপর দিয়ে। আবার তিনি সেখান থেকে নিকলী দামপাড়া হয়ে অষ্টগ্রামে পৌছতেন। কিশোরগন্জ শহরের বুক চিড়ে পালতোলা নৌকা এখন আর চলে না। শোনা যায় না মাঝির কন্ঠের গান। কারণ নরসুন্দা এখন এক মৃত নদীর নাম। বাংলার আদি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজরিত এই নদীটিকে মৃত ঘোষণা করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কোনো এক সময় ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে। পরবর্তীতে বিভিন্ন বাঁধ সৃষ্টি করে এর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করা হয়। এভাবেই ইতিহাসের পাতায় নরসুন্দা কিশোরগন্জের এক মৃত নদী নামে ঠাঁই হয়। তবে আশ্চর্য হলেও বাস্তবতা এই যে, কালের ইতিহাসে মৃত নরসুন্দার একটি অংশ আজো জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে বহমান নিকলী দামপাড়ায়। এখনো এটি নাব্যতা হারায়নি সেখানে। নিকলী দামপাড়ার ইতিহাসে এই নদীটি স্বতন্ত্রভাবে স্থান পেয়েছে।

কত সুফি দরবেশের পদচিহ্নে ধন্য হয়েছে এর দুই তীর। ১৬শ শতকে তরফ রাজ্যের সিপাহসালারদের সমসাময়িক নিকলীতে ইসলাম প্রচারক শাহ গুন জালাল ইয়ামেনী রাহঃ এই নদীপথেই এসেছিলেন। মধ্যযুগের সাধক ও লোককবি মাহমুদজান ফকির এর তীরেই বেড়ে ওঠেছেন। আজকের নিকলীর নৌকাবাইচের সূচনা ও উৎপত্তি এর শেষ সীমানা থেকেই।

মুসলিম নবাব সুবেদার ভূস্বামীগণ নৌকাবাইচের প্রচলন করেন। পূর্ববঙ্গের ভাটি এলাকায় নৌশক্তি রাজ্য রক্ষা ও রাজ্য জয়ের একমাত্র উপায়। কথিত আছে, ভাটি মুলুকের রাজা ঈশাখাঁ’র গোপন নৌঘাটি ছিল অষ্টগ্রামে। উক্ত নৌঘাটির মহড়া অনুষ্ঠিত হতো সোয়াইজনী থেকে শুরু হয়ে নরসুন্দায় গিয়ে শেষ হত।

ভাটির আরেক সিপাহসালার সরওয়ার খাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন জনপদ “সরওয়ার মহল” ভাটির অন্যতম প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। বর্তমান এর নাম শহরমূল। এটি নরসুন্দার তীরে গড়ে উঠেছে। মূলত নিকলী দামপাড়া তথা ভাটি এলাকার অন্য বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে এই নদীটিকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশ পিরিয়ডে এই নদীর তীরেই গড়ে ওঠেছিল বাংলার অন্যতম বৃহত্তম জুট মিলস। যার খ্যাতি দেশ পেরিয়ে নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় এই নদীতেই ল্যান্ড করতো ইংল্যান্ড থেকে আগত জুট মিলস জেডি প্লেন। বর্তমান ইন্ডিয়ার বিরলা কোম্পানী ও তাদের ব্যবসা পরিচালনা করেছেন এখানে এসে। ফরাসী বণিকরা এই নদীর তীরেই গড়ে তুলেছিল শুটকি মাছের কুঠি। আরো কত বণিক, কত শ্রমিক, কত পর্যটকের নীরব সাক্ষী এর দুই তীর। আজ সবই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে রেখে গেছে কিছু স্মৃতি চিহ্ন। এখন বিশ্বায়ন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এর জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে।

বর্তমানে এই নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে বিশালাকা দামপাড়া, মজলিশপুর গ্রামে। দুই পাড়ে দুটি বাজার। দামপাড়া কারার মাহতাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। দুটি ব্রিজ। নিকলীতে এখনো এর দুই তীর ব্যবসা-বাণিজ্যের জমজমাট কেন্দ্র। এখানকার মৎস, ধান, দুধ, দেশব্যাপী সমাদৃত। শুকনো মৌসুমে এর দুই তীর ভাটি এলাকার নৌ নির্মাণ শিল্পের জন্য দেশব্যাপী প্রশিদ্ধ লাভ করেছে। বর্ষকালে নরসুন্দা হয়ে উঠতে পারে পর্যটকদের নতুন আকর্ষণ। হাওর ভ্রমণের প্রবেশদ্বার এর চারদিকে বর্ষায় গ্রাম আর হাওর নদী একাকার হয়ে ওঠে। যেন এক উড়াল পঙ্খীর দেশ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!