নিকলী-বাজিতপুরে আওয়ামীলীগ-বিএনপি সমানে সমান!

সাইফুল হক মোল্লা দুলুখন্দকার মাহবুবুর রহমান ।।

নির্বাচনী তৎপরতা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আসন্ন নির্বাচনে তুমুল লড়াই হবে কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। কারণ বিএনপি এ আসনে শক্ত অবস্থানে থাকলেও পিছিয়ে নেই আওয়ামী লীগও।

এর আগের ১০টি নির্বাচনে এখানে পাঁচবারই জয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন তিনবার। তাই আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে মরিয়া দুই দলের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি আফজাল হোসেন ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলকে অনেকটাই গুছিয়ে এনেছেন। অন্যদিকে, ক্ষমতার বাইরে থাকলেও পিছিয়ে নেই বিএনপিও। তবে এ আসনে দুই দলের বিরুদ্ধেই নানা দুর্নাম রয়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা জানান, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির মজিবুর রহমান মঞ্জুর সময়ে বাজিতপুর ও নিকলীতে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। জিম্মি হয়ে পড়ে স্থানীয় জনগণ। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের আফজাল হোসেনের সময়েও প্রায় একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই এমপির ভাই ও আত্মীয়স্বজনরা নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে জনপ্রতিনিধিদের গড়ে তোলা বাহিনীর কাছে বাজিতপুর ও নিকলীর স্থানীয় মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে।

আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা জানান, আফজাল হোসেন এমপি হওয়ার পর ক্ষমতার জোরে দলের বাজিতপুর উপজেলা আহ্বায়ক হন। এ সময় পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে তার ভাই আশরাফ হোসেনকে জয়ী করার জন্য ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়, সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। এই এমপির সায় না থাকলে থানায় মামলাও করা যায় না। স্থানীয় প্রশাসন চলে না। বর্তমান এমপির এই ধরনের অপকর্মের জবাব দেয়ার জন্য ভোটাররা প্রস্তুত হয়ে আছেন।

আগামী নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হচ্ছেন বর্তমান এমপি আফজাল হোসেন, বাজিতপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউল হক, বাজিতপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শেখ একেএম নুরুন্নবী বাদল, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন, বাজিতপুর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি গোলাম রসুল দৌলত, মুক্তিযোদ্ধা আবুল মনসুর বাদল, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিল্টন ও সাংবাদিক ফারুক আহম্মদ।

তাদের মধ্যে আফজাল হোসেন মনে করছেন, আবারও তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন। তার মতে, জনপ্রিয় হওয়ায় তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি দলের কয়েকজন নেতা অকারণেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যাচার করছেন। তার কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা না পেয়ে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাতে তিনি দমবেন না। কারণ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ভোটাররাও তার সাথে রয়েছেন। তিনি জানান, দলের দুঃসময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংগঠনিক কাজ করেছেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দলকে আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী করেছেন। তার সময়ে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে।

আওয়ামী লীগের বাজিতপুর উপজেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মাস্টার মোবারক হোসেন বলেন, আফজাল হোসেনই যোগ্য প্রার্থী। তিনি এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন, সংগঠনের হাল ধরেছেন। বাজিতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ছারোয়ার আলমের দৃষ্টিতেও আওয়ামী লীগে আফজাল হোসেনই উপযুক্ত প্রার্থী। তিনিই দলের মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলাউল হক। নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনেও তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন। দলের নীতিনির্ধারকরা তাকেই মনোনয়ন দেবেন বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।

দলের বাজিতপুর উপজেলা শাখার সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শেখ একেএম নুরুন্নবী বাদল জানান, ক্ষমতা মানুষকে কতটা স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে, তা এ আসনের নাগরিকরা টের পাচ্ছেন। কিন্তু কথিত প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউই মুখ খুলছেন না। এ অবস্থায় তিনি দলে জবাবদিহি ফিরিয়ে আনা এবং প্রকৃত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করছেন। আম-জনতার প্রতিনিধি হিসেবে দল আগামী নির্বাচনে তাকেই মনোনয়ন দেবে বলে তিনি মনে করছেন।

২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন অজয় কর খোকন। তিনি প্রত্যাশা করছেন, এবার দল তাকে মনোনয়ন দেবে।

বাজিতপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল দৌলত বলেন, মাঠপর্যায়ে দলকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তারও বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনিও জনগণের বিপদ-আপদের সঙ্গী। জনগণের লোক হিসেবে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন তিনি।

আবুল মনসুর বাদল বলেন, তিনি ২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি। এবার তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।

ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিল্টন জানান, তিনি দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার প্রতিটি কাজে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দলের জন্য তার পরিবারের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করেন তিনি।

জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি ফারুক আহম্মদ বলেন, দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশায় তিনি এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার ছেপেছেন। কিন্তু বর্তমান এমপি আফজাল হোসেনের লোকজন তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।

এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি আমির উদ্দিন আহমেদের ছেলে অ্যাডভোকেট বদরুল আলম মিঠু, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শফিকুল আলম রাজন, দলের কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল, বাজিতপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র এহেসান কুফিয়া, সাবেক এমপি মজিবুর রহমান মঞ্জুর ছেলে মাহমুদুর রহমান উজ্জ্বল, সাবেক এমপি খালেকুজ্জামানের চাচাতো ভাই ছালেহুজ্জামান খান রুনু, কেন্দ্রীয় শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক তফাজ্জল হোসেন বাদল এবং ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ নাসির।

দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, বাজিতপুর ও নিকলীর মানুষ ক্ষমতাসীনদের অত্যাচার ও নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছে। তারা আগামী নির্বাচনে বিএনপিকেই বেছে নেবে।

দলের নিকলী উপজেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট বদরুল আলম মিঠু বলেন, তার বাবা এই আসনে তিনবারের সাবেক এমপি। তাই আসনটি পুনরুদ্ধার করতে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে দল তাকে মূল্যায়ন করবে বলে তিনি আশা করছেন।

বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী শফিকুল আলম রাজন বলেন, দলের দুঃসময়ে এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় নিকলী-বাজিতপুরের মানুষ আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন। তবে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কেউই সম্ভাব্য প্রার্থী শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন না।

শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল বলেন, বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের আগে নির্বাচিত হতে পারেনি। তারা সব নির্বাচনেই ১০-২০ হাজার ভোটে পিছিয়ে থাকে। গত উপজেলা এবং পৌরসভা নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থীই বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ভোট ডাকাতি করে তাদের বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। তবে আগামী নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকার আর কেড়ে নিতে দেয়া হবে না। তিনি দলের মনোনয়ন চাইছেন।

এহেসান কুফিয়া জানান, নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তিনি তৃণমূলে কাজ করছেন। উঠান বৈঠক করছেন। নেতাকর্মীদের সাথেও নিবিড় যোগাযোগ রাখছেন। মনোনয়ন পেলে তিনি নির্বাচিত হবেন।

দলের জেলা সদস্য মাহমুদুর রহমান উজ্জ্বল জানান, তার বাবা দুইবারের সাবেক এমপি। বাজিতপুর ও নিকলীতে তার বাবার বহু সমর্থক রয়েছেন। তারাই তাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাকে হতাশ করবেন না বলে তিনি মনে করছেন।

সূত্র : আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে হবে তুমুল লড়াই  [সমকাল, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭]

Similar Posts

error: Content is protected !!