১৯৯৪ সাল। কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের গৌরাঙ্গবাজারে কোহিনূর কমার্শিয়াল কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিলো (এখন আছে কিনা জানি না)। এক বড়ভাইয়ের সুপারিশে টাইপ শিখতে ভর্তি হলাম। ইংরেজি ও বাংলা। কলেজে আমার পাঠ্য বিষয় ছিলো টাইপ অ্যান্ড শর্টহ্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটির প্রশিক্ষক ছিলেন মশিউর ভাই; খুবই ভালো মানুষ।
ওখানে শেখানো হতো স্টেপ বাই স্টেপ। কী গুলোকে প্রধানত তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছিলো। প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছিলো “হোম” কী। অক্ষর সংবলিত তিন সারির মাঝের ধাপটিকে হোম কী বলা হয়। মাঝের সারির ইংরেজি ১০টি কী’র মধ্যে A S D F ; L K J এই আটটি মূলত হোম কী হিসেবে পরিচিত।
স্বাভাবিক জীবনযাপনের সাথে তাল মিলিয়ে মশিউর ভাই খুব সহজ বর্ণণায় বোঝাতেন হোম কী-গুলো। যেমন, বাড়ি থেকে ভিন্ন গন্তব্যে বের হই; কাজ শেষে সেই বাড়িতেই ফিরে আসতে হয়। ঠিক তেমনি প্রধান তিন ধাপের মধ্যে ওপর ও নিচের দুইটি সারির কী-গুলোর কাজ শেষে মাঝের সারিতে (হোম কী) ফিরে আসতে হবে। আসতে হয়। হ্যাঁ, অনেকটা স্থায়ী বিশ্রামাগারও বলা যায় এই কীগুলোকে।
মশিউর ভাইয়ের অধীনে প্রশিক্ষণকালীন বার বার বলতাম, ভাই শুধু একটা ধাপ কেন, সবগুলো একবারে শেখান। এতে সময় কম লাগবে; এক কাজে সময়ক্ষেপণ তেমন একটা মেনে নিতে পারতাম না বিধায় এমন কথাগুলো বলা হতো। তিনি খুব যত্নের সাথে বোঝাতেন, “আরে মিয়া আগে নিজের বাড়িটা তো ভালো করে চিনে নাও। তারপর অন্যের বাড়িতে আসা-যাওয়ার রাস্তা”।
ছোটকাল থেকেই অস্থিরচিত্তের মানুষ হিসেবে পরিচিত এই আমি। মশিউর ভাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ সেই কথাগুলো খুব তেঁতো লাগতো। কখনো কখনো নিজেই নিজের প্রশিক্ষক হয়ে উঠতাম। সবগুলো কী ব্যবহার করে কোনো বই বা কাগজ খুঁজে নিয়ে সেগুলো টাইপ শুরু করতাম। চা-নাশতা সেরে মশিউর ভাই ১৫-২০ মিনিট পর ফিরে এসে বলতেন, “কীরে ভাই, তুমি অন্যের বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করছো কেন! তোমার কাজ শুধুই নিজ বাড়িতেই থাকা। আর যেন এমন না করো; যতক্ষণ আমি না বলছি”। নির্দেশ না মানায় অভিভাবকের চেহারায় শাসাতেন ছিপছিপে গড়নের মশিউর ভাই। ভালো থাকবেন প্রিয় ভাই; আপনার কথা অনেক মনে পড়ে। শিক্ষাগুলোও।
মূল কথায় আসি। গত রাতে (১৬ জানুয়ারি ২০১৮) অফিস শেষে বাসায় ফিরতেই স্ত্রীর বায়না, “বাড়ি যাবো”। বাড়ি মানেই কিশোরগঞ্জ জেলার প্রিয় নিকলী উপজেলা। সেই পৈত্রিক ভিটা। শৈশব-কৈশোরের অফুরন্ত স্মৃতিগাঁথা, মায়া-মমতা মাখানো জন্মভূমির গন্ধ। সেই বন্ধু-বান্ধব, হয়তো সবাইকে পাবো না। ঘুরে ফেরার জায়গাগুলো দেখা হবে; মনে মনে সেখানেই খুঁজে নেবো জমে থাকা স্মৃতিগুলো।
ছোটবোনের বিয়ে (উঠিয়ে দেয়া) ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার। আত্মীয়তার হিসেব মতে দাওয়াত ছিলো কনে-বর দুই পক্ষেরই। শুক্রবার কনে পক্ষে, শনিবার বরপক্ষের। দাওয়াত পেয়ে খুবই গুরুত্বপুর্ণ (হা হা হা!) ব্যক্তি মনে হচ্ছিলো। ভাবনায় ছিলো ১৮ জানুয়ারি বড় ছেলের নতুন স্কুলে প্রথম দিন যাওয়ার বিষয়। বাড়ি যাওয়া ও বিয়েতে উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হয়ে আসছিলো। সেই সাথে ঢাকায় বাসা পাল্টানো ও এডজাস্টমেন্টের জন্যে টানা ৮ দিন ছুটি কাটিয়েছে এ মাসেই।
এদিন (১৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বউ-শাশুরি ফোনে কথা বলেছেন। শাশুরি (আমার আম্মা) বার বার বললেন, “বউরে তোমরা চলে আসো। অনেক দিন তো হলো বাড়িতে আসা হয় না। আসার ভাড়া মিটিয়ে কষ্ট করে আসো; ফেরার খরচ আমি তোমাদের দিয়ে দেবো!” মা তো, তিনি মায়ের মতোই ভেবেছেন ও বলেছেন। বউ সিদ্ধান্ত এক ধরনের নিয়েই ফেললো; বাড়ি যাবে। ছেলের স্কুলের প্রথমদিনের বিষয়টা পরে দেখা যাবে। বাড়িতে যাবার স্ত্রীর বায়না শুনে প্রথমে একটু রেগেও যাই; আমি ছেলেটার স্কুলে হাজিরা বিষয়ে একটু বেশিই সিরিয়াস বলেই। তার ওপর নতুন স্কুল। নিয়ম-কানুন তেমন জানা নেই।
অবশেষে সব হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো, “বাড়ি যাচ্ছি”। ১৮ জানুয়ারি; সকাল সাড়ে ১০টায়। মানে মশিউর ভাইয়ের জীবনমুখী শিক্ষার “হোম কী”তে ফিরছি। দেখা হবে বন্ধু-স্বজনরা। একেবারে ক্ষুদ্র সময়ের ট্যুরে যতটা সম্ভব মিশতে চেষ্টা করবো চিরচেনা মাটি আর বাতাসের গন্ধে। ভালোবাসার চোখ মেলতে চেষ্টা থাকবে অবারিত সবুজের মাঠে; যেখানে বর্ষায় পানিরা থৈ থৈ করে ভাসিয়ে বেড়ায় আনন্দে। প্রাণের নিকলী হয়ে ওঠে এক উচ্ছ্বল “পর্যটনে সম্ভাবনার” নগরীতে।