আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
হাদিয়ার বিয়ে সংক্রান্ত মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল, কারও ব্যক্তিগত অধিকারে রাষ্ট্র বা পরিবারের নাক গলানোর অধিকার নেই। হাদিয়া এবং শাফিন একসঙ্গে থাকতে পারবেন।
ফের যুগান্তকারী রায় দিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। কেরলের ২৪ বছরের যুবতী হাদিয়ার বিয়ে সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল, কোনো সাবালক মহিলার বৈবাহিক বিষয়ে কারও মত প্রকাশের অধিকার নেই। বিষয়টি একান্তই তাঁর এবং স্বামীর ব্যক্তিগত বিষয়।
ঘটনার সূত্রপাত গত বছরে। কেরলের একটি হোমিওপ্যাথি কলেজের ছাত্রী ছিলেন হিন্দু পরিবারের সন্তান অখিলা অশোকান। সেখানেই তাঁর প্রণয় হয় এক মুসলিম ছাত্র শাফিন জাহানের সঙ্গে। এর কিছুদিন পর অখিলা-শাফিন বিয়ে করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ায় বিয়ের পর অখিলা অশোকানের নাম হয়ে যায় হাদিয়া জাহান। বিয়ের পর শাফিন-হাদিয়া একসঙ্গে থাকতেও শুরু করেন। হাদিয়ার পরিবার বিয়েটি মেনে নেয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, এটি একটি ‘লাভ জিহাদ’এর ঘটনা।তাঁদের দাবি, অখিলা, অর্থাৎ হাদিয়াকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মান্তরিত করেছেন শাফিন। এখন তাঁদের মেয়েকে সিরিয়া অথবা ইরাকে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও অভিযোগপত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সেখানে আরো বলা হয়, সিরিয়া বা ইরাকে নিয়ে হাদিয়াকে আইএস জঙ্গিদের ক্যাম্পে রাখা হবে। মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। কেরালা হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। সুতরাং, হাদিয়া এবং শাফিনের বিয়ে এখনই মান্যতা পাচ্ছে না। হাদিয়াকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁর বাপের বাড়িতে।
এরপরেই কেরালা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন শাফিন এবং হাদিয়া। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বেঞ্চে ওঠে মামলা। প্রথম শুনানিতেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, হাদিয়ার মামলাটি স্পর্শকাতর এবং তাঁর সঙ্গে যে ব্যবহার হয়েছে, তা সংবিধানসম্মত নয়। হাদিয়াকে ফের কলেজে গিয়ে ক্লাস শুরু করতে বলা হয়। বস্তুত, হাদিয়ার যাতে ক্লাস করতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে বিষয়ে হোমিওপ্যাথি কলেজটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, দুই সাবালকের বিয়ের বিষয়ে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মত প্রকাশের অধিকার নেই। হাদিয়া এবং শাফিন দু’জনেই প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। ফলে তাঁরা একসঙ্গে থাকতেই পারেন। এখানে ‘লাভ জিহাদ’এর প্রসঙ্গ টেনে আনার কোনো অর্থ নেই। যদি তাঁদের কারও সঙ্গে আইএস’এর মতো জঙ্গি সংগঠনের সম্পর্ক থাকে, তাহলে তা নিয়ে আলাদা মামলা হতে পারে। এনআইএ তদন্তও করতে পারে। কিন্তু তাই বলে দু’জনকে আলাদা থাকার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে না।
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ‘লাভ জিহাদ’ শব্দ দু’টি ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের বাতাসে। কোনো কোনো সংগঠনের অভিযোগ, মুসলিম সংগঠনগুলি ভালোবাসার মাধ্যমে হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তরিত করছে। উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ একদা ‘লাভ জিহাদ’এর বিরুদ্ধে একটি দলও তৈরি করে ফেলেছিলেন। অভিযোগ, ‘লাভ জিহাদ’ বন্ধ করার নামে সংখ্যালঘু অঞ্চলে তারা হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতো। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো অঞ্চলে ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে বহু জলঘোলা হয়েছে। বহু মিশ্র ধর্মের বিয়ের ঘটনা ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। দম্পতিকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করা, মারধর করার ঘটনাও ঘটেছে।
সম্প্রতি অন্য একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী যে কোনো সাবালক ব্যক্তির নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার অধিকার আছে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেছিলেন, ‘লাভ জিহাদ’।
‘অনারকিলিং’ ইত্যাদি বিষয়গুলি মাথায় রেখেই সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় দিয়েছিল। হাদিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আরও একবার সেই কথাই স্পষ্ট হলো। যদিও এনআইএ’এর দাবি এ বিষয়ে তাদের তদন্ত অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। কীভাবে ধর্মান্তরিত করে ভারতীয় মহিলাদের জঙ্গি কার্যকলাপে অংশ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, সে বিষয়ে তাদের তদন্ত চলছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট বক্তব্য, দু’টি তদন্তের বিষয় এক নয়। জঙ্গি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তদন্ত চলতেই পারে। কিন্তু তার সঙ্গে দুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে জড়ানো কখনোই সংবিধান সম্মত নয়।
সূত্র : হিন্দু-মুসলিম বিয়েতে আদালতের যুগান্তকারী রায় [ডয়চে ভেলে, ২৩ জানুয়ারি ২০১৮]