পূর্ণিমা- বাঙালীর শৌর্যের মুখ

রাজীব সরকার পলাশ ।।

অন্ধকারে চাই আলো। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সে আলো যদি বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে দিয়েও হয়’।

সবার মনে না থাকলেও আমার স্পষ্ট মনে আছে। অনেক ঘটনাই অনেক নাড়া দেয়, কষ্ট দেয়, পোড়ায়। তাদের মধ্যে একজন পূর্ণিমা। যা তখন জাতিকে অন্য মাত্রায় পরিচয় করে দিয়েছিল। ১ অক্টোবর ২০০১ সাল। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। নির্বাচন পরবর্তী বিজয় উল্লাস রূপ নেয় নগ্নতা আর সহিংসতায়। যার প্রভাব পড়ে অধিকাংশ প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর। অশ্লীল, নির্মমতা, অমানবিক আচরণ আর মধ্যযুগীয় কায়দায় মেতে ওঠে একটি গোষ্ঠী, একটি দল। তাদেরই লোলুপ চরিত্রের সহিংসতার শিকারের একজন পূর্ণিমা শীল। বাবার নাম অনীল শীল। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া পূর্ব দেলুয়ার গ্রামের বাসিন্দা।

২০০১ সালে পূর্ণিমা তখন উল্লাপাড়া হামিদ পাইলা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ৯ ভাইবোনের বৃহৎ সংসারের বাবা অনীল শীলের সেলুনটি একমাত্র আয়ের উৎস। পাশের বাড়ির বাবলু ডাক্তারের দু’মেয়েকে মাত্র ১২০ টাকার বেতনে নিয়মিত পড়াত পূর্ণিমা। ৮ অক্টোবর ২০০১ সাল। প্রতিদিনের মতই টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে পূর্ণিমা। তখনো সে জানে না, কি নিকষ কালো অমাবস্যা তার জন্য অপেক্ষা করছে । পরক্ষণেই তৎকালীন জোট সরকারের একদল শ্বাপদ ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। হিংস্র আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয় পূর্ণিমা। পালাক্রমে ধর্ষণ করে মা-বাবার সামনে পূর্ণিমাকে। এক পর্যায়ে ব্যর্থ মা, ধর্ষকদের অনুরোধ করে বলে, “আমার মেয়েটা খুব ছোট, তোমরা একজন একজন করে যাও বাবারা”। নির্মমতা কতটুকু হলে, এমন কথা বেড়িয়ে আসে একজন মায়ের মুখ থেকে; তা আমার জানা নেই।

তবুও ক্ষান্ত হয়নি নরপিশাচেরা। রাজনীতি নামক অপসংস্কৃতির উল্লাসে পূর্ণিমা’র চিৎকারে ভারী হয়ে পড়ে উল্লাপাড়া। খবরের কাগজগুলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এই তাণ্ডবের খবর। ১১অক্টোবর উল্লাপাড়ার নাগরিক সমাজ তাকে নিয়ে আসে উপজেলা সদরে। নিরাপত্তার কথা ভেবে পূর্ণিমাকে কলেজপাড়া এলাকার গনেশ শীলের বাড়িতে এনে তাকে রাখা হয়। সেখান থেকেও তাকে গুম করার চেষ্টা করে সন্ত্রাসীরা। কারণ তা করা গেলে বলা যাবে, আওয়ামী লীগের লোকজন তাকে সরিয়ে ফেলেছে এবং পূর্ণিমা ধর্ষণের ঘটনাটি একটি নাটক।

এরপর পূর্ণিমার নিরাপত্তার জন্য দু’জন নিয়মিত পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয় এবং ৭ জনের একটি মোবাইল টিম গঠন করা হয়। ২০ অক্টোবর ২০০১ সালে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে নির্মম এই “পৈশাচিক” ঘটনার বর্ণনা দেন পূর্ণিমা। এরপরেই মিডিয়া পুরোপুরি সরগরম হয়ে ওঠে। প্রতিদিন পূর্ণিমাকে নিয়ে কলাম, সংবাদ আর প্রতিবাদের ঝড় বইতে থাকে সারাদেশে। প্রকাশিত হয় সবুজ ওড়নায় পূর্ণিমার মুখে চেপে ধরা লজ্জ্বা আর ঘৃণ্য প্রতিবাদের ছবি। পূর্ণিমাকে নিয়ে তখন বিশ্বমানবতার মুখোমুখি বাংলাদেশ। ধর্ষণ ঘটনা ধামাচাপা দিতে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য এম আকবর আলী সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, ‘ঘটনা সাজানো তবুও উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’ এরপর চলে অন্য চেষ্টা। পূর্ণিমার পরিবারকে ২০ হাজার টাকার মাধ্যমে পূর্ণিমা ধর্ষিত হয়নি এমন লিখিত দেয়া প্রস্তাব প্রদান করে ধর্ষক পক্ষ। তাও ব্যর্থ হয়।

১৩ নভেম্বর ২০০১ সালে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী, সাংবাদিক ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের একটি দল সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ার উদ্দেশ্যে “পূর্ণিমা যাত্রা” করে। পূর্ণিমাকে তারা একটি মানপত্র প্রদান করে। ওয়াহিদুল হক বলেছিলেন, ‘পূর্ণিমা আমার কলঙ্ক, জাতির কলঙ্ক, সবার কলঙ্ক’। আমি জাতির হয়ে পূর্ণিমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।” পূর্ণিমার হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি। তখন পূর্ণিমার ঘরে অবস্থান করা প্রতিটি মানুষ দাঁড়িয়ে চোখ মুছে ছিলেন। পূর্ণিমার অপরাধ একটাই ছিল। সে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করেছিল।

পূর্ণিমা’র ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমার কাছে সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট। প্রতিদিন পত্রিকায় পূর্ণিমাকে খুঁজে ফিরেছি তখন। পূর্ণিমা আমার বোনের প্রতিকৃতি। কি করা হল তার জন্য! কোনো আলোর মুখ দেখছে কি পূর্ণিমা? নাকি অন্ধকারের অতল গহীনে অন্যদের মতো হারাবে! আমার বিশ্বাসও তাই ছিলো, অমবস্যার কালো অন্ধকার চিরে বের হয়ে আসবে আলো। পূর্ণিমা সম্ভ্রম হারায়নি, হারিয়েছে জাতি। পূর্ণিমা আমার কাছে এক আদশের্র নাম। পূর্ণিমা বাঙালীর শৌর্যের মুখ। বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে আলোকিত হয়েছে পূর্ণিমা।

অনেক দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার তার ওপর সুনজর দিয়েছে। গত কয়েকদিন হয় মাননীয় প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন- ‘মনে পড়ে সেই পূর্ণিমাকে? ২০০১-এর ১ অক্টোবর নির্বাচন পরবর্তী পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ১৪ বছরের মেয়েটি। হ্যাঁ, আমি সিরাজগঞ্জের সেই পূর্ণিমা শীলের কথা বলছি। আজ আমি গর্বিত। আমি পূর্ণিমাকে আমার “পার্সোনাল অফিসার” হিসেবে নিয়োগ দিলাম’। পূর্ণিমা, তোমাকে আমরা ভুলে যাইনি। জীবনের অন্ধকার রূপ তুমি দেখেছো, আলোর জগতে তোমায় স্বাগতম… শুরু হোক নতুন পথচলা। তোমাকে অভিবাদন প্রিয় পূর্ণিমা।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, কটিয়াদী সহিত্য সংসদ; এবং সম্পাদক, সুকুমার রায় আবৃত্তি পরিষদ, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।

Similar Posts

error: Content is protected !!