অনুপম মাহমুদ ।।
কন্যা সুন্দর আলোয় এখন বিয়ের কনে দেখা হয় না হাওরে। বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে অনেক আগেই। বিজলী বাতির ছোঁয়ায় দিবা রাত্রির ফারাক এখন বোঝা কঠিন হবার কথা ছিলো। তবে হাওরে এই কথা এখনো অবান্তর! এখানে কখনোই বিদ্যুৎ যায় না বলে অনেকেই মজা করেন। কারন বিদ্যুৎ মশায় মাঝে মাঝে উঁকি দিতে আসেন হাওরবাসীকে জানান দিতে যে, এখানেও বিদ্যুৎ আছে! তবে কনের বাপের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই, এটা হতে পারে না! মান সম্মানের ব্যাপার…
কিছু প্রশ্ন করি আপনাকেঃ
১. বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত ও পিছিয়ে পরা জনপদের নাম কি?
০২. কোথায় ডাক্তার সাহেব নিজের পোষ্টিং দেখতে চান না?
০৩. শিক্ষায় পশ্চাৎপদ অঞ্চলের নাম বলুন?
০৪. যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক কোন অঞ্চলে?
০৫. অপুষ্টির শিকার হয়ে খর্বাকৃতির সন্তান জন্ম নিচ্ছে কোথায়?
সকল প্রশ্নের একমাত্র ও সরল উত্তরঃ হাওর। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই ৭ টি জেলার প্রায় ৩৪ টি উপজেলায় বিস্তৃত ৪১১ টি ছোট বড় হাওর নিয়ে আমাদের ভাটি এলাকা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের প্রায় ৮০০০ বর্গমাইল, অর্থাৎ প্রায় ৭ ভাগের এক ভাগ। ষোল কোটির এক অষ্টমাংশ অর্থাৎ দুই কোটি মানুষের আবাস এই হাওর এলাকায়।
হাওর একটি বিচিত্র এলাকা। দেশের অন্য যে কোন এলাকা থেকে এটা সম্পূর্ণরূপে আলাদা। এখানকার ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, যানবাহন সব কিছুই ব্যতিক্রম। প্রায় চার মাস এই বিপুল অঞ্চল পানিতে নিমগ্ন থাকে।
হাওর এলাকা জীব বৈচিত্রে ভরপুর। এখানে বেশ কিছু ব্যাতিক্রমধর্মী উদ্ভিদ দেখা যায়, যেমনঃ হিজল, তমাল, করচ, ভুই ডূমুর, জল ডুমুর, বরুণ, হোগলা, নল খাগড়া, বনতুলসী, বলুয়া ইত্যাদি। এছাড়া হাওরে প্রচুর শাপলা, শালুক, ঢ্যাপ ইত্যাদি জলজ গুল্ম আছে প্রচুর পরিমানে।
হাওর দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এখানে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া শিং, মাগুর, পুটি, বোয়াল, বাইম, টাকি, প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। দেশের মোট মৎস্য সম্পদের প্রায় ২৫ ভাগ মৎস্যের যোগান দেয় হাওর। এছাড়া দেশের মোট গবাদি পশুর ২২ শতাংশ আসে এখান থেকে।
আমাদের হাওর এখন পাল্টে গিয়েছে অনেকটাই। কৃষি ভিত্তিক গ্রামীন অর্থনীতি এখন শিল্প কারখানার মজুর তথা শ্রম নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। হাওরের তরুণেরা এখন চোখ রাখছেন প্রবাসে কিংবা নগরে। রেমিটেন্সের কাঁচা অর্থে ফুলে ফেঁপে উঠছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। কিন্তু হাওর যে হারিয়ে ফেলছে তার স্বকীয়তা, তার কি দেখার কেউ নেই?
মূলত কৃষি ও মৎস্য আহরণ এই হাওরের দুটি প্রধান পেশা। গেল বছরের আগাম পানি চলে আশায় গোটা হাওর অঞ্চলে ধান উৎপাদন ব্যাপক ভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। কৃষকের কান্নার নোনা জলে স্ফীত হয়েছে হাওরের জলরাশি। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় মৎস্য সম্পদের ব্যাপক মড়ক ছিলো অপ্রত্যাশিত এবং অবর্ণনীয়। এ বছর যুক্ত হয়েছে আরেকটি নতুন সমস্যা। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও ভাটির পানি নেমে যায়নি বিভিন্ন যায়গা থেকে ফলে কৃষক তার বীজতলা তৈরী করতে পারেনি। তাই এবারো হয়তো কৃষক বঞ্চিত হবেন…
প্রকৃতির সাথে হাওরের নিবির বোঝাপড়ার মধ্যে একটা বড়সড় ঝামেলা বেঁধে গেছে সম্প্রতি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন এর জন্য দায়ী বলে আমার মনে হয়। পানি পথ শুকিয়ে গেলে হাওরের বুক চিরে তৈরি হয়েছে সড়ক। এই সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করেছে উন্নত। অনেক পরিবেশবিদ মনে করছেন পলি জমে যাওয়ার অন্যতম কারন হচ্ছে এই আভুরা সড়ক। প্রকৃতি কোন প্রকার ইন্টারভেনশন পছন্দ করে না, হাওরে এই বক্তব্য প্রমাণিত হলো আবারো। এর ফলশ্রুতিতে এখন হাওর ও নদীতে পানির উচ্চতা সম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে ফলে হাওরে তৈরী হয়েছে জলাবদ্ধতা।
সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে ভৈরব বাজারের কাছে কালনি নদীর মোহনায় ড্রেজিং করা হচ্ছে এই ধারনা থেকে, হয়তো এতে হাওরে আটকে থাকা পানি নেমে যাবে। তবে কোন ধারনার ভিত্তিতে এই উদ্যোগের সূত্রপাত, তা জানা যায় নি। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা এখন সময়ের দাবী। কোন প্রকারের হাতুড়ে চিকিৎসা হবে হাওরকে মৃত্যুর কোলে সোপর্দ করার শামিল।
Sluice gate/Regulator নির্মাণ করা হয় মূলত পানির চলার পথকে একটি কাঠামোতে পরিচালনা করার জন্য। কিন্তু এই গুরুত্ব্যপূর্ণ অবকাঠামোর ৮০% বর্তমানে অকার্যকর বলে উল্লেখ করেছেন ডক্টর আইনুল নিশাত। দেশের স্বনামধন্য এই পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন এই তথ্য। তদারককারী সংস্থার দিকে এই অব্যবস্থাপনার দায় তিনি চাপিয়েছেন।
তবে আমি হাওরের গনমানুষের সাথে কথা বলে জেনেছি, তারাও ভাবছেন পলি জমেছে হাওরের বুকে। নদী ও হাওরের সঙ্গমস্থলে পলি জমে মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত নদীতে ড্রেজিং করা হলেও হাওরে এমন উদ্যোগ কখনোই দেখা যায়নি। নদ নদী শুকিয়ে গেছে কোথায়। প্রসস্থ নদী হয়েছে সরু। সেই সাথে হাওর অঞ্চলে অসংখ খাল বিল এখন বিপুপ্ত প্রায়। তাই হাওরের পানি নদী ও খালে সংকুলান না হওয়ায় আগেই চলে আসছে ফলে কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন প্রত্যাশিত উৎপাদন থেকে। আর পানি নেমে যাবার রাস্তা সঙ্কুচিত হওয়ায় এখন নামতেও পারছে না নিরধারিত সময়ে ফলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা।
হাওর অঞ্চলে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় তা এবার হয়নি। তার উপর উত্তর বঙ্গে বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে। তার প্রভাব পড়েছে বাজারে। মোটা চাল গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশী এখন বাংলাদেশে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত বাংলাদেশ বাধ্য হয়েছে অনেক বছর পর চাল আমদানি করতে। এখনো হাওর অঞ্চলে সরকার খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী চালু রেখেছে সীমিত পরিসরে হলেও। এর চাপ পড়ছে গোটা অর্থনীতি ও খাদ্য মজুদে।
আমরা হাওরবাসী কখনো ত্রাণ নেবো হাত পেতে স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু তাই হয়েছে এবার। আমাদের হাওরের জীবন ও ঋদ্ধ সংস্কৃতি এখন বিপন্ন। হাওরের সহজ সরল গনমানুষের স্রোত এখন তপ্ত নগরীর রাজপথে। কৃষাণীর কোমল হাত রক্তাক্ত হচ্ছে শিল্পের সূচে…
হাওর অঞ্চল একটি বিশেষায়িত অঞ্চল। আমাদের জন্য ভাবতে হবে বিকল্প পদ্ধতিতে। মাটি ও পানির মানুষ আমরা, আমাদের মতোই থাকতে চাই। আমাদের নিয়ে অনতিবিলম্বে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হউক। হাওরের অমিত সম্ভাবনা এভাবে ধ্বংস করে দেবেন না।
নীতি নির্ধারক মহল ও দেশবাসীর প্রতি আকুল আবেদন, হাওরের জন্য একটু ভাবুন, আমাদের পাশে থাকুন…
দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে এমনিতেই টালমাটাল দেশের অর্থনীতি। দুই কোটি হাওরবাসী কাজ হারিয়ে ছুটে আসবে নগরে, বেঁচে থাকার তাগিদে। তাদের জন্য দুই বেলা খাবার যোগাতে পারবে তো বাংলাদেশ…
লেখক : উন্নয়ন কর্মী