মোশতাক আহমেদের কাব্যগ্রন্থ ভাসাও ভেলা এই বেলা

এস এম মুকুল ।।

কবিতার বই : ভাসাও ভেলা এই বেলা, কবি মোশতাক আহমেদ। প্রকাশ করেছে- পুথিনিলয়, পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৬৪, দাম- ১২০ টাকা, প্রচ্ছদ- রাসেল রানা। বইটি পাওয়া যাবে- একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়, স্টল নম্বর ২০০-২০২।

মানুষ সে যতই বড় হোক- শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতিকাতরতা যেন আমরণ তাঁর ভেতরে বাহিরে চেতনার ঢেউ তুলে। আর অবাধ্য ঢেউয়ের উচ্ছলতায় কবি মন বলে উঠে- এখানে আকাশ নেই, পলাতক চাঁদ/ ছায়া ফেলে উড়ে যায় প্রাচীন শকুন/ ভয়ার্ত আদিম চিৎকারে কাঁদে/ জ্যোৎস্নার ফসিল- ‘জ্যোৎস্নার ফসিল’ এমন চমৎকার শব্দচয়নে কবি মোশতাক আহমেদ ‘কংশ এখন জ্বলন্ত চিতা’ শিরোনামের কবিতায় কংশনদীকে কাব্যিক উপমায় কালের সাক্ষী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

কবির জন্ম নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার সিংধা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। শৈশব কেটেছে কংশ পাড়ের মেঠো পথে জাম, বরুন আর হিজলের ছায়ায় হেঁটে হেঁটে। কবি মোশতাক আহমেদ সত্তরের দশকের প্রগতিশীল রাজনীতির তেজস্বী কর্মী; যিনি সমাজের আলো-অন্ধকারের জরাজীর্ণতার জঞ্জাল ছিন্ন করে বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করান প্রতিনিয়ত অন্য আলোর কাব্যিক ভাবনায়। তাঁর কাব্যময়তা দ্রোহ-প্রেম-প্রীতির অমীয় লীলাখেলা। কবিতায় আছে ক্রোধ-ক্ষোভ- অসংকোচ প্রতিবাদের অকপট উচ্চারণ।

সমাজের ভাব-গবি আর অসঙ্গতির প্রতি তীব্র তিরষ্কার ফুটে উঠেছে এমন কাব্যিক ব্যঞ্জনায়- বেহায়া মরদ, তোমার মুরোদ বুঝেছি/ লজ্জা করে না গতরে বুলাও হাত?/ জঠর জ্বলছে ক্ষুধার জ্বালায়/ উনি এসে তাও পিরিতি ফলায়।’ সত্যিই সমাজের ভেতরের কু-প্রবৃত্তিকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। প্রেম যেন তাঁর কবিতায় অন্যূন গভীরে ইস্ফিত আস্কারায় মাতাল মুহ্যতা ছড়ায়। প্রেমকাতুর কবি বলেছেন- ‘আমি বললাম ‘তোমার চুল তো দেখি/ আগের চেয়ে আরো বেশি কালো হয়েছে এখন’।/ ‘কচুপাতা রঙটা বুঝি এখনও তোমার প্রিয়ই আছে?’/ ‘শাড়িটা কিন্তু তোমায় মানিয়েছে বেশ’। আবার তিনি প্রেমিকার প্রতি বাসনার খেদ প্রকাশ করেছেন- ‘আসতে যদি সময় মতো দেখতে বিকেল কেমন করে/ চপল চোখের দৃষ্টি ছুড়ে পালিয়ে বেড়ায় এদিক ওদিক/ আলোর সাথে খেলা করে দেখতে আরও সকাল বেলায়/ গোলাপ কলি কেমন করে পাঁপড়ি মেলে।’

কবি মোশতাক আহমেদের এই কাব্যগ্রন্থে যেসব শিরোনামের কবিতা ঠাঁই পেয়েছে- কংশ এবং জ্বলন্ত চিতা, ভাসাও ভেলা এই বেলা, অক্টোপাস, ঘৃণা জানাবার ভাষা চাই, কমরেড জসীম মণ্ডল, কলিকালের ছড়া, লজ্জা, মুখগ্রন্থের চিল, খতনামা, ঐশীকে, বেহায়া মরদ, তুমি যদি বলো, কবিতা ও তুমি, অনুভব, দ্বিধা, সন্ধি, আসতে যদি সময়মতো, নীরবতা-১, নীরবতা-২, অনুকবিতা, আফগানিস্তান, আগুনিয়া গাং-এর কথা- প্রভৃতি। সাবলীলতা, সৃষ্টিশীল জীবনবোধ, সুস্থ রাজনীতির বিকাশ, ভালোবাসার মোহন মায়া আর মানবিক মূল্যবোধকে খুঁজে ফেরা একজন নিবিষ্ট ফেরারি তিনি। তিনি জীবিকার প্রয়োজনে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। সর্বশেষ জাতিসংঘের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার হিসেবে আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

নিয়মের ছকে বাঁধা চাকরি জীবন থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। জীবনের একপ্রান্তরে একষট্টি পেরিয়ে এসে অবসরের সঙ্গী হিসেবে কলম ধরেছেন তিনি। অসময়ের অন্ধকার অবগাহনকে কবি চিহ্নিত করেছেন ঠিক এইভাবে- লখিন্দরকে কেটে গেছে বিষাক্ত নাগ/ সেই কবে/ এখনও তবু প্রস্তুত নয়- তোমার ভেলা! বেহুলা আর কেন দেরি তবে/ যেতে হবে দূর মনসার ঘাট/ আর কেন দেরি তবে/ এখনই সময় বেহুলা/ ভাসাও ভেলা এই বেলা। ‘ভাসাও ভেলা এইবেলা’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

Similar Posts

error: Content is protected !!