আজিজুল হক বিপুল, মহাস্থান (বগুড়া) প্রতিনিধি ।।
কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের উৎপাদন প্রতি বছরই বগুড়ায় বাড়ছে। বিসিক শিল্পনগরী ছাড়াও শহর ও শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হচ্ছে পাওয়ার টিলার, ডিজেল ইঞ্জিন (শ্যালো মেশিন), রাইসমিল, জুটমিলসহ বিভিন্ন কলকারখানার যন্ত্রাংশ। তৈরি হচ্ছে টিউবওয়েল, ধান-গম ও ভুট্টা মাড়াই মেশিন। চাল, হলুদ, মরিচ গুড়া করা মেশিন, লায়নার, পিস্টন, সেন্ট্রিফিউগ্যাল পাম্পসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। যা দেশের কৃষি যন্ত্রাংশের ৮০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে।
বিসিক কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঞ্চাশের দশকে জেলায় প্রতিষ্ঠিত ভারী শিল্পগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তরা শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসেন। জেলার ফুলবাড়ি এলাকায় ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় ৩৩ দশমিক ১৭ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় বিসিক শিল্পনগরী। গড়ে ওঠে ৯২টি শিল্প ইউনিট। যার মধ্যে প্রকৌশল শিল্প, টেক্সাইল শিল্প, খাদ্য ও সহায়ক শিল্প, কেমিক্যালস ও ফার্মাসিউটিক্যাল, পেপার বোর্ড ও মুদ্রণ শিল্প, গ্যাস সিরামিক শিল্প অন্যতম। এখন বিসিক নগরীতে ৮৯টি উৎপাদনরত শিল্প কারখানা রয়েছে। বিসিক নগরীর বাইরে বগুড়া স্টেশন রোডের রেলওয়ে মার্কেট, ফুলবাড়ি, মাটিডালি, চারমাথা, তিনমাথা রেলগেট, ছিলিমপুর, ফুলতলা, বনানী, দ্বিতীয় বাইপাস সড়ক, এরুলিয়া, শাকপালা, নেংরা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় কৃষিকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।
বগুড়া স্টেশন রোডের রেলওয়ে মার্কেটের রিদওয়ান মেশিনারিজের মালিক সাব্বির আহম্মেদ জানান, কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয় এ ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরির দুটি কারখানা তাদের রয়েছে। সেখানে পাওয়ার টিলারের খুচরা যন্ত্রাংশ, ডিজেল ইঞ্জিনের পুলি, লাইনার, পিস্টন, সেন্ট্রিফিউগ্যাল পাম্প, অটো থ্রেসার মেশিন, ধান, গম, ভুট্টা মাড়াই মেশিন, শস্য ঝাড়াই যন্ত্র, চোপার মেশিন তৈরি হচ্ছে। একই মার্কেটের মোয়াজ্জেম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের কর্মচারী রেজা জানান, বিসিক থেকে ঢালায়ই লোহা কিনে এনে তাদের এখনে কাটিং-ফিনিশিংয়ের মাধ্যমে ডিজেল ইঞ্জিনের বিভিন্ন সাইজের ‘পুলি’ ব্যবহার উপযোগী করা হয়।
বৃষ্টি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের খোকন চন্দ্র দেবনাথ জানান, বিসিক থেকে ছোট-বড় সাইজের লাইনারের ঢালাই কিনে তার প্রতিষ্ঠানে কাটিং করে ব্যবহারের উপযোগী করে বিক্রি করা হয়। প্রতি পিস লাইনার পাইকারি ১৫০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। স্কেল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের মালিক আব্দুল হালিম মন্টু জানান, তিনি তেল, পাম্প তেল, সয়াবিন তেল মেশিন, চাল ভাঙানো মেশিন, হলুদ, মরিচ গুড়া করা মেশিন তৈরি করেন। সরিষা থেকে তেল করার মেশিন প্রতি পিস ৪৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন।
বগুড়ার সান্তাহার রোডের মুরইল এলাকায় অবস্থিত এ রহমান মেটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল রহমান জানান, তাদের মেটালে ১৭ মডেলের টিউবওয়েল তৈরি করা হয়। এসব টিউবওয়েল কক্সবাজার, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, সাতক্ষীরা, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় বাজারজাত হয়। তা ছাড়া কৃষিকাজের জন্য ট্রাক্টরের ব্রেকড্রামও এই মেটালে তৈরি করা হয়।
ফোরাম অব অ্যাগ্রো মেশিনারিজ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রসেসিং জোনের সভাপতি গোলাম আজম টিকুল জানান, বগুড়ায় উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় কৃষি যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ তৈরি ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিকাশ ঘটছে। উৎপাদন খরচ সামঞ্জস্যের মধ্যে থাকায় দেশের অধিকাংশ এলাকায় বগুড়ার উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ বাজারজাত হচ্ছে। বিসিক ছাড়াও শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় কৃষি ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা গড়ে উঠেছে। যা দেশের ৮০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে। এই শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।
বগুড়া বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক জাহেদুল ইসলাম জানান, বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদনের প্রসার অব্যাহত রয়েছে। বিসিকে শিল্প প্লট না থাকার পরও নানা জায়গায় অনেক কারখানা তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে। বগুড়ায় উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ দেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বগুড়ার উপ-মহাব্যবস্থাপক মকবুল হোসেন জানান, জেলায় ১৭টি মাঝারি, দুই হাজার ৪২৩টি ক্ষুদ্র ও ১৫ হাজার ৭২২টি কুটির শিল্প রয়েছে। এসব শিল্পের কারণে বগুড়ায় দ্বিতীয় শিল্পনগরী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।