নুসরাত শারমিন ।।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলেন স্টিফেন হকিং। খুব মেধাবী। শিক্ষকদের প্রিয় ছিলেন। অংকে ছিল দক্ষতা। কিন্তু গল্পের শুরু হয় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পার্টি থেকে। সেখানেই স্টিফেনের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় সাহিত্যের ছাত্রী জেনের। এরপর তাদের বন্ধুত্ব, অতঃপর প্রেম।
একবার ব্ল্যাক হোল বিষয়ক একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন একটি নতুন তত্ত্ব। ‘পুরো মহাবিশ্ব সৃষ্টির নেপথ্যে কাজ করছে ব্ল্যাক হোল’ এই তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গবেষণা চলাকালীন সময়ে তিনি ‘মোটর নিউরন’ নামে রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসক জানান, দুরারোগ্য এই রোগে কিছুদিনের মধ্যেই তার শরীরের বিশেষ কিছু অঙ্গে কোনো অনুভূতি থাকবে না। এমনকি তিনি হয়তো আর দুই বছরের মধ্যে মারাও যেতে পারেন।
স্টিফেন হকিং এমন কথা শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। প্রেমিকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কিন্তু জেন তাকে ছেড়ে যাননি। এমন অনিশ্চয়তার মাঝেও নিখাদ ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। তিনি হকিংকে বিয়ে করেন। কিছুদিন পরে তাদের একটি সুস্থ সন্তান হয়।
সিনেমার গল্পের মতো মিষ্টি এই ঘটনাটি স্টিফেন হকিং এর জীবনের ঘটনা। আর তার জীবনের ঘটনাগুলোকেই সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’ ছবিতে। পরিচালনা করেছেন জেমস মার্শ। জেন হকিং রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ট্রাভেলিং টু ইনফিনিটি : মাই লাইফ উইথ স্টিফেন’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে এই ছবিটি। ১২৩ মিনিটের এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন অ্যান্থনি ম্যাককার্টেন।
‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’ ছবিতে স্টিফেন হকিং চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইডি রেডমাইনে। তার অভিনয় নজর কেড়েছে দর্শকদের। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তিনি স্টিফেন হকিংয়ের জীবন ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। স্টিফেন হকিং নিজেও মুগ্ধ হয়েছেন ইডি রেডমাইনের অভিনয়ে। ইডি রেডমাইনেকে নিয়ে তিনি পোস্ট করেছিলেন তার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে। ইডি রেডমাইনে সেরা অভিনেতা হিসেবে ২০১৫ সালে জিতে নিয়েছিলেন অস্কার। জেন হকিংয়ের চরিত্রে অভিনয়কারী ফেলিসিটি জোনের অভিনয়ও প্রশংসা পেয়েছে অনেক।
ছবির গল্পে স্টিফেন হকিং এর ধীরে ধীরে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া এবং তার পাশাপাশি প্রচণ্ড মানসিক শক্তির জোরে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো দেখানো হয়েছে। এর মাঝে জন্ম হয় স্টিফেন হকিংয়ের দ্বিতীয় সন্তানের। হকিং এবং সন্তানদের দেখাশোনা করতে করতে ক্রমেই বিষণ্ণ হয়ে ওঠেন জেন। নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। বিষয়টি লক্ষ্য করে স্টিফেন হকিং তখন স্ত্রীকে গির্জার গানের দলে যোগ দেয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে গানের শিক্ষক জনাথন স্টিফেনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জেনের। জনাথন স্টিফেন হয়ে ওঠেন পারিবারিক বন্ধু। এরপর জন্ম হয় হকিং এর তৃতীয় সন্তানের।
হকিং এর জীবন রক্ষার্থে তার কণ্ঠনালীতে ট্রাকিওটমি স্থাপন করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু এটাও জানিয়ে দেয়া হয়, জীবন বাঁচলেও আর কখনো কথা বলতে পারবেন না হকিং। তবে প্রযুক্তির সাহায্যে তার লেখাকে কণ্ঠে রূপ দেয়া যেত। এই পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমেই ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম’ রচনা করেন স্টিফেন হকিং। বইটি আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক বিক্রিত হয় এবং তাকে পুরস্কৃত করার জন্য আমেরিকা থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে আমেরিকা যাওয়ার আগে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে বৈবাহিক বিচ্ছেদে রাজি হন। বিচ্ছেদের পর জেন এবং জনাথন স্টিফেন বিয়ে করেন। ছবিটির শেষ অংশে দেখানো হয় ব্রিটেনের রানীর সাথে দেখা করার জন্য প্রাসাদ চত্বরে সাবেক স্ত্রী জেনি ও তার সন্তানদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন হকিং।
২০০০ স্টিফেন হকিংয়ের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া সাতটি ভাষণের সমাহার ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’ বইয়ের নামে নামকরণ করা এই ছবিটি দেখলে চলচ্চিত্র প্রেমীরা তার ছাত্র জীবন, প্রেম, অসুস্থতা, দাম্পত্য এবং কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে পারবেন। অবশ্য রোমান্টিক ড্রামা ঘরানার এই চলচ্চিত্রটিতে হকিংয়ের ভালোবাসার গল্পটিই মুখ্য হয়ে ফুটে উঠেছে।
বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। ক্যামব্রিজে নিজ বাসভবনে আজ বুধবার (১৪ মার্চ) সকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র : থিওরি অব এভরিথিং: স্টিফেন হকিংয়ের প্রেম, বিষাদ ও অন্যান্য [চ্যানেল আই অনলাইন, ১৪ মার্চ ২০১৮]