বিশেষ প্রতিনিধি ।।
মোঃ নিলয়। সবে দশম শ্রেণীর ছাত্র। নিজের নামে কিছুটা বৈচিত্র্য এনে নতুন নাম রেখেছেন “নিলয় প্রধান”। তথ্য-প্রযুক্তির এই স্বর্ণসময়ে সমাজের অন্য শিশু-কিশোরের চেয়ে তার জীবনমান অনেকটাই আলাদা। নিজেকে নিজেই সাজাচ্ছেন প্রযুক্তির এক-একটি শাখার আলোয়। যেখানে স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটারে গেম খেলে আর বিনোদনের নানান মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকে তার বয়সীরা, সেখানে নিলয় ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে নিজ গুণেই। জাগিয়ে চলেছেন তার ভেতরকার সৃষ্টিশীল মননকে।
স্কুলজীবনের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসী এই কিশোর এমএস-ওয়ার্ডের একটি কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান তাকে A+ গ্রেডসহ সার্টিফিকেট প্রদান করেছে। কম্পিউটার বা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটিই তার একমাত্র প্রশিক্ষণ। সেই থেকে আর পেছন ফেরেননি অদম্য নিলয় প্রধান। নিজেকে পরিচয় করাচ্ছেন তথ্য-প্রযুক্তির একের পর এক ভাষার সাথে। এসব কাজে তার ভরসা গুগল ও ইউটিউব। যখন যে বিষয়ে জানার আগ্রহ জন্মায়, সাথে সাথে সার্চ করে জেনে নিচ্ছেন।
শুরুটা তার এরকম, ২০১৪ সালে তার এক চাচাতো ভাইয়ের কম্পিউটারে ঘাটাঘাটি। গান শোনা, ভিডিও দেখা আর গেম খেলার জন্য বাসার অন্যরা ব্যবহার করতেন কম্পিউটার। তবে নিলয়ের আগ্রহ ছিলো কম্পিউটারে ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও এ কেন্দ্রিক সেটিংসগুলো। তার এমন জিজ্ঞাসু কর্মকাণ্ডে প্রায়ই কম্পিউটারে নানান সমস্যা দেখা দিতো। ক’দিন পরপরই অপারেটিং সিস্টেম নতুন করে সেটাপ করা লাগতো। কখনো কখনো বাসার কেউ কেউ অপারেটিং সিস্টেম নষ্ট হওয়ায় বিরক্ত হতেন। তবে তার কম্পিউটার ব্যবহারে বাধা হয়ে দাঁড়াননি কেউই। এরপর ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে শেখেন অপারেটিং সিস্টেম সেটাপ করা।
আগ্রহ বেড়ে যায় কিশোর এই ভাবুকের। এবার কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, মাদারবোর্ড সেটিংসসহ বেশকিছু বিষয়ে তিনি জানতে শুরু করেন। খুব পরিচিত মনে হতে থাকলো নতুন এ জগত। বেড়ে যায় তার জানতে চাওয়ার পরিধি। নজর ফেললেন একটু ভিন্ন জগতের দিকে। ভাবতে থাকলেন, কিভাবে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারগুলো কাজ করছে! যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। ইন্টারনেট দুনিয়ায় ঘুরেফিরে পরিচিতি পান HTML-এর।
ছুটেচলা ভাবনাগুলো প্রতিনিয়ত ডানা মেলতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে নতুন নতুন দ্বার উন্মোচনে। “কিভাবে কাজ করে, কিভাবে তৈরি করা হয় সফটওয়্যার। কী-ই বা তথ্য-প্রযুক্তির ভাষা!” হ্যাঁ, তিনি এবার ভাষা বুঝতে চান। শুরু হয় ইন্টারনেট দুনিয়ায় একের পর এক খোঁজাখুজি। এভাবেই তিনি পরিচিত হতে থাকেন প্রোগ্রামিং ভাষার সাথে। এরই মধ্যে তিনি আয়ত্ত করেন C#, C, C++, PHP, JAVA, Python, Ruby, Visual basic ইত্যাদি।
এবার কিছু একটা করতে চান কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার ক্ষুদে ভাবুক নিলয় প্রধান। তার প্রথম প্রজেক্ট হিসেবে বেছে নেন নিজ স্কুল নিকলী জি.সি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়কে। শুরু করেন বিদ্যালয়কেন্দ্রিক সকল ধরনের তথ্যভিত্তিক একটি এনড্রয়েড এপস তৈরির কাজ। যেখানে থাকবে বিদ্যালয়ের ইতিহাস, সকল শিক্ষকের ছবি, শিক্ষকদের ঠিকানা, পদ-পদবি, কোন শিক্ষক কোন বিষয়ে ক্লাস নেন, সকল শিক্ষকের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা (মোবাইল নম্বরসহ), বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন, অনলাইনে বিদ্যালয়ের নোটিশ, সরকারি ছুটির দিন, পরীক্ষার ফলাফলসহ বিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় সকল তথ্য। এছাড়াও যুক্ত থাকবে অনলাইনে শিক্ষা সম্পর্কিত ভিডিও দেখা, আনলাইনে MCQ পরীক্ষা, অনলাইন থেকে পাঠ্যবই ডাউনলোড, পত্রিকা পড়ার সুবিধাসহ নানান রকমের সকল তথ্য ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় আরো অনেক রকম সুবিধা। এক কথায় একজন শিক্ষার্থীর যে সকল সুবিধার প্রয়োজন হয় তার সবই থাকবে এতে।
ঠিকই ভেবেছেন। ছোটকাল থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী অদম্য নিলয় এরই মধ্যে এনড্রয়েড এপসটি তৈরি করেছেন। চলছে স্বল্প পরিসরে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নির্দিষ্ট কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিয়মিত দেখছেন এপসে সংযোজিত তথ্য এবং এর কার্যক্রম। সমস্যার খুঁটিনাটি সংশোধন ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি সাপেক্ষে আগ্রহী সকলের জন্য শিগগিরই অনলাইনে উন্মুক্ত করা হবে এপসটি।
নিলয় জানালেন, তার এই এপস তৈরির প্রজেক্টে বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক সহযোগিতা করেছেন। তন্মধ্যে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু ইমরান রানা স্যারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি শুরু করে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয় এপসের প্রাথমিক পর্যায়। এ পর্যন্ত ধাপে ধাপে অনেক আপডেট করা হয়েছে। স্বল্প সময়ে এমন প্রয়োজনীয় কাজটি সারতে পেরে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আশাবাদী নিলয়। “সবাই আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন। মা-বাবা, পরিবার, সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বন্ধুরা আমাকে যেভাবে সমর্থন যুগিয়েছেন; এতে আমার দায়িত্ববোধ আরো বেড়ে গেছে। নিজ বিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতার অনুভব থেকে এপসটির মাধ্যমে সবাইকে সেবা দিতে চাই। আমার জন্য দোয়া করবেন।”
স্কুলে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাদান সম্পর্কে নিকলী জি.সি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান শাখায় পড়ুয়া নিলয় জানালেন, দেশকে তথ্য-প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে হলে স্কুল পর্যায়েই এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রসারের সুযোগ করে দিতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজসহ সকল স্তর থেকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রোগ্রামিংসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে দায়িত্বরত শিক্ষকদের ধারণা সীমিত। এদিকে সকল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ নজর দেবেন বলে নিলয়ের প্রত্যাশা।
নিকলী সদর নগরের বড়বাড়ীর ছেলে নিলয় প্রধান দৃঢ়তার সাথে জানালেন ভবিষ্যতে তার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা। “আমার বিশ্বাস, আল্লাহর রহমতে ও সবার দোয়ায় একদিন আমি বড় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবো। সে পথে সফলতা অর্জনে সকলের দোয়া, সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করছি।”
ছোটকাল থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী অদম্য নিলয়ের প্রেরণার বাতিঘর বাবা-মা ও তার পরিবার। প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে পরিবারের সকল সদস্যের অকুণ্ঠ সমর্থন। বাবা হেলিম মিয়া একজন ব্যবসায়ী। তথ্য প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিকলীকে মেলে ধরার নিলয়ের এই প্রয়াস এগিয়ে যাক অনেক দূর। এজন্য দরকার পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা।
নিকলী উপজেলাকেন্দ্রিক প্রথম অনলাইন সংবাদমাধ্যম “আমাদের নিকলী ডটকম” এবং ঢাকাস্থ নিকলী সমিতির পক্ষ থেকে এই ক্ষুদে ভাবুক নিলয় প্রধানের সাফল্যে অনেক অনেক শুভ কামনা।