কারার মাহমুদুল হাসান ।।
সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে (১২/০৩/২০১৮) বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদকে নয়াদিল্লিতে ইন্টারন্যাশনাল সোলার কনফারেন্সে যোগদানকালে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন তার দেশ পানি বণ্টন সমাধান চাইছে। সংশ্লিষ্ট সবার সাথে এ নিয়ে আলোচনাও চলছে। নয়াদিল্লিতে সম্মেলনের ফাঁকে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে দু’জনের মধ্যে সংক্ষিপ্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১১ মার্চ ২০১৮ তারিখে। রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ নরেন্দ্র মোদিকে বলেন, বাংলাদেশ সব সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে এবং দিন দিন এ সম্পর্কে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি বেশ কিছুকাল পর দুই প্রতিবেশী দেশের শীর্ষপর্যায়ে আলোচনায় আসল।
বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রপতিকে জানান, তার দেশ বর্তমান বিষয়টির সমাধান চাইছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সাথে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনাও চলছে। এর আগে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও এর ওপর তিস্তার পানির সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেন।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে সাথে রাখার নরেন্দ্র মোদির (২০১৫) প্রয়াসের বিষয়টি রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেন।
২০১১ সালে ভারতীয় কংগ্রেস শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে ড. সিংয়ের সফরসঙ্গী হওয়ার সব আয়োজন সত্ত্বেও ঠিক এক দিন আগে ড. সিংয়ের সফরসঙ্গী হতে নিজের নাম কেটে নেন মমতা ব্যানার্জি। এ ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। এর প্রায় চার বছর পর নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের (যদিও আলাদাভাবে) এক দিন আগেই মমতা ব্যানার্জি ঢাকায় হাসিমুখে (জুন ২০১৫) ঢাকার মাটিতে পা রাখলেন। তার সফরসঙ্গী হওয়ার মূল এবং সম্ভবত একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত (ছিটমহল) চুক্তি অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তরের ঘটনা এবং উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সে অনুষ্ঠানে মমতা ব্যানার্জি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন।
মোদি-মমতার ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের বিভিন্ন দিক আবেগ আর সাফল্যে ঠাসা মর্মে অত্যন্ত উচ্ছ্বাসপূর্ণ যেসব খবর ছেপেছে ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন খবরমাধ্যমে, সেসবের কিছু নমুনা এখানে দেয়া যেতে পারে : ‘মোদি মমতার আবেগরুদ্ধ ঢাকা’ এমন শিরোনামে খবর ছেপেছে কলকাতার সংবাদ প্রতিদিন। তাদের দৃষ্টিতে, ‘শুক্রবার রাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় পৌঁছানোর পরই আবেগের মাত্রা বাড়তে শুরু হয়েছিল। শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় পা দেওয়ার সাথে সাথে সে আবেগের মাত্রা সপ্তমে পৌঁছায়।’
মোদি প্রসঙ্গে আবেগে ভেসে যাওয়ার কথা জানিয়েছে অনলাইন পোর্টাল ওয়ান ইন্ডিয়াও। আর মমতা প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য, ‘রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এয়ার ইন্ডিয়ার কলাকাতা-ঢাকা রুটের নিয়মিত যে উড়ানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন, সেই উড়ানটির ‘ভিআইপি’ মর্যাদা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। অর্থাৎ বিশেষ নিরাপত্তায় ওড়ার জন্য এর ধারেকাছে আর কোনো বিমানকে ওড়ার অনুমতি দেওয়া হবে না।’
আর প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার ঢাকার রাজপথ আদৌ বাংলাদেশের না ভারতের, তা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ‘আবেগে চাপা পড়েছে বিরোধী সুর’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে পত্রিকাটি বলেছে, ‘চোখ বেঁধে এই শহরের যেকোনো মোড়ে বা রাস্তায় নিয়ে এসে রুমাল খুলে দিলে কারো পক্ষে হঠাৎ বোঝা অসম্ভব, এটা কোন জায়গা’। রাস্তার দুই ধার, চৌমাথা, উঁচু উঁচু হোল্ডিং সবই তো নরেন্দ্র মোদির ছবিতে সয়লাব! বিস্ময়ে গাঢ়তর হবে যখন নজরে পড়বে, মোদির নানা পোশাক ও ভঙ্গির পোস্টারের পাশেই হাসিমুখে বিরাজমান (যদিও সেই পোস্টার সংখ্যায় কম) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! এটা কি আসানসোল, না কলকাতা, নাকি…!’ এসবই আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশের যৎকিঞ্চিত নমুনা।
এত সব আনন্দ উচ্ছ্বাসপূর্ণ খবরাখবরের মধ্যে অবশ্য তিস্তা নিয়ে ইতিবাচক খবর খুব একটা ছিল না। ওই সফরের সপ্তাহখানেক আগে ৩০ মে ২০১৫ তারিখে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যসরকারের সচিবালয় ‘নবান্ন’ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় (সন্ধ্যায়) গণমাধ্যম কর্মীদের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সফরে তিস্তা পানিচুক্তি বাদ। আমি ৫ জুন ঢাকায় যাচ্ছি, ফিরব ৬ তারিখে।’ এর বেশি কোনো কথা বলেননি তিনি। তবে প্রকাশ্যে না বললেও বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে একান্তে আলোচনায় কী সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন সেটা স্পষ্ট করেননি তখন পর্যন্ত। কারণ, স্থলসীমান্ত চুক্তির পর যে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি- সেটা অবশ্যই তিস্তাচুক্তি। এ নিয়ে জটিলতা কিভাবে কাটবে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জট ছাড়াতে কী উদ্যোগ নেবেন- তা ওই সফরের সময়ই খোলাসা হবে বলে সবার ধারণা ছিল।
৬ জুন ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক সফরে এসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্থলসীমান্ত চুক্তির মতো বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা নদীর পানিচুক্তির অঙ্গীকার করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও এ ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন। মোদি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে অব্যাহত সহযোগিতা দানের কথাও বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ২০২১ ও ২০৪১ সালের ভিশন অর্জনে সফলতা কামনা করেন মোদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দৃঢ়তার সাথে বলেন, দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সম্ভাবনার যুগ ও অধিকতর উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছি। ভারত বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ। আমরা পরস্পরের উন্নয়ন সহযোগী। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের মধ্যে সংযোগ (কানেকটিভিটি) স্থাপনের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ ক্ষেত্রে সহায়তার আশ্বাস দেন। পাশাপাশি উভয়ের উদ্বেগ ও অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেন।
শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি ৬ জুন ২০১৫ বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে একান্ত বৈঠক ও দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেন। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা, পরিবেশ, সীমান্ত ও বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ১৯টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর এবং দলিল বিনিময় হয়। দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সেসব সম্পাদিত হয়।
শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উপস্থিতিতে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনপত্র বিনিময় হয়। তিনজনই আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে আগরতলা পর্যন্ত এবং ঢাকা থেকে গৌহাটি পর্যন্ত বাস চলাচল কার্যক্রম উদ্বোধন করেন।
দুই প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক আলোচনার আগে প্রায় ২০ মিনিট একান্ত বৈঠক করেন। মমতা ব্যানার্জিও দুই প্রধানমন্ত্রীর সাথে কিছুক্ষণ বৈঠক করেন। মমতা তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নেবেন বলে দুই প্রধানমন্ত্রীকে জানান। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, ‘মমতার সবুজ সঙ্কেতের পর এখন তিস্তাচুক্তি হবে। আজ দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি এক ইতিহাস রচনা করবেন। যেমনটি স্বাধীনতার পর করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দ্রিরা গান্ধী। এখন দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মোড় নেবে।’ ইকবাল সোবাহান চৌধুরী এ আশাবাদ বেশ আবেগপূর্ণ ছিল, তবে বাস্তবে এর প্রতিফলন এখনো যৎকিঞ্চিতও দৃশ্যমান হয়নি। সে যা-ই হোক।
তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের হিন্দুস্তান টাইম পত্রিকার ০৬/০৬/২০১৫ তারিখে ‘তিস্তা বাংলাদেশের মনোদহনের কারণ’ শীরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল যাতে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে ঐতিহাসিক হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। অবধারিতভাবেই এ সময় তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আলোচনায় আসবে। ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশে খুব আবেগের একটি স্থান।’ এতে বলা হয়, ১৬১টি ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ৪১ বছরের পুরনো সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে যাচ্ছে দু’টি দেশ। অথচ দফায় দফায় আলোচনা হওয়ার পরেও তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মতানৈক্য রয়েই গেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে ৫৪টি অভিন্ন নদী প্রবাহিত হচ্ছে। যেগুলোর পানি তাদের ভাগাভাগি করে নেয়ার কথা। তবে কোনোটি নিয়েই তিস্তার মতো বিরোধ নেই।
তিস্তার পানি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে রাজ্য। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কিছু করার নেই। আর গোড়া থেকেই এ বিষয়ে মত নেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আলোচনা নানা পর্যায়ে নানা জটিলতায় বহু বছর ধরে ঝুলছে এই কাক্সিত চুক্তি। আর মমতার ক্ষেত্রে এখন বিষয়টি রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে। সামনে ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচন। এ অবস্থায় পানি নিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিপাকে পড়তে পারেন তিনি, এ আশঙ্কা তার ছিল। ২০১১ সালেও দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছিল। মমতার বাধার কারণে ৫০:৫০ পানিবণ্টনের ওই চুক্তিতে সই করা যায়নি। এর পর থেকে তিস্তার পানিপ্রবাহ কমছে বলে অভিযোগ করে আসছে ঢাকা। প্রতিবারই পশ্চিমবঙ্গ জানিয়েছে, তাদের দিকেও পর্যাপ্ত পানি নেই। কৌশলগত বিশেষজ্ঞ এবং ‘ওয়াটার : এশিয়া’স নিউ ব্যাটেলগ্রাউন্ড’ বইয়ের লেখক ব্রাহ্মা চ্যালানি বলেন, ‘এই শতাব্দীতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পানিচুক্তি বিশ্বের কোথাও সই হয়নি। ভারতের প্রতিটি রাজ্যই নিজের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। নেহরু একসময় যা করেছিলেন তা আর সম্ভব নয়। রাজ্যের স্থানীয় স্বার্থ বাদ দিয়ে পাকিস্তানের সাথে সিন্ধু চুক্তিতে সই করেন তিনি।’
‘তিস্তায় আগে খনন, পরে চুক্তি’ শীরোনামে ঢাকার একটি পত্রিকায় ২৩/০৬/২০১৫ তারিখে প্রকাশিত খবরে বলা হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদী তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের আগে নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে খননের চিন্তা করা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সর্বশেষ সফরে এ বিষয়ে ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে ঢাকাকে। বলা হয়েছে, নদীতে পানি না থাকলে বণ্টন চুক্তি কারো জন্যই লাভজনক হবে না। তাই যৌথভাবে তিস্তা নদী খননের জন্য ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অবশ্য ভারতীয় পক্ষের পানির সমবণ্টনের বিষয়েও আপত্তি আছে। যদিও নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিক বৈঠকসহ কোনো পর্যায়েই বণ্টনের পরিমান সম্পর্কে কোনো ধরনের মন্তব্য করেননি। নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধরনের চিন্তাভাবনা কালক্ষেপণেরই নামান্তর।
সূত্র মতে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক থেকে যৌথ ব্রিফিংয়ে দেয়া বক্তব্যেও (জুন-২০১৫) নদীর পরিচ্ছন্নতার কথা বলেছেন। মোদি বলেছেন, ‘ভারতের রাজ্য সরকারগুলোকে সাথে নিয়ে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানির বিষয়ে একটি সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছতে পারব বলে আমি আত্মবিশ্বাসী। তবে নদীগুলোকে পুনর্জীবন ও পরিষ্কার রাখতে আমাদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে। নয়াদিল্লি ও কলকাতার সূত্রগুলো বলেছে, এই পুনর্জীবন ও পরিচ্ছন্নতার অর্থ নদী খনন বা ড্রেজিং। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, তিস্তা পানি বণ্টন ইস্যু আরো তালগোল পাকানোর জন্য নতুন করে ভারতের পক্ষ থেকে ফেনী নদীর পানিসংক্রান্ত বিষয়টিকে ভারত আচমকা একসাথে জুড়ে দিলো।
জানা যায়, ২০১১ সালে তিস্তাচুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হলেও তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতায় আর চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হয়নি। শুধু তা-ই নয় তিস্তাচুক্তির বিষয়েও আলোচনা বন্ধ হয়ে যায় তখনি। এরপর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে (১৯/০২/২০১৫) মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরে তিস্তা আবার আলোচনায় আসে। চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মমতা তার ওপর আস্থা রাখতে বলেন। একইভাবে নরেন্দ্র মোদির সফরের সময়ও তিস্তাচুক্তি ছিল অন্যতম সর্বোচ্চ আগ্রহের বিষয়। অবশ্য সফরের আগেই প্রকাশ্যে ঘোষণাই ছিল তিস্তা চুক্তি এবার স্বাক্ষর হচ্ছে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় দেয়া দুই ভাষণেই এসেছে তিস্তাচুক্তি প্রসঙ্গ। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি ঢাকা সফরের মতোই মোদির সফরেও তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরের কোনো সময়সীমা ঘোষিত হয়নি। কলকাতার কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জি বা পশ্চিমবঙ্গকে না জানিয়ে পানি বণ্টনের হিসাব চূড়ান্ত করা হয়েছিল অভিযোগ এনে শেষ মুহূর্তে চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করেছিলেন মমতা। এখন ভারতের বিজেপি সরকার যেহেতু চুক্তি স্বাক্ষরে মমতাকে যুক্ত করেছে, কাজেই মমতার মতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এটা স্পষ্ট। তার আগের যে আপত্তি ছিল, সেটাও সুরাহা হবে বলে আশা করা হয়। সে হিসেবে মমতা ঢাকা সফরে তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরে যে টেকনিক্যাল সমস্যার কথা বলেছেন, সেটাই এখন মূল আলোচ্য বিষয়। সূত্র মতে, মমতা ব্যানার্জি আবার পশ্চিমবঙ্গের পানিবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে তিস্তার পানি ইস্যু বিষয়ে নিযুক্ত করতে যাচ্ছেন। তিনি পানিপ্রবাহের পরিসংখ্যান নিয়ে নতুন করে আরেকটি সমীক্ষা করবেন। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতে তিস্তাচুক্তির চূড়ান্ত করা খসড়ায় পরিবর্তন আনতে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে নতুন করে আলোচনা করবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তখন নতুন করে পানিবণ্টনের অনুপাত নির্ধারণ ও নদীর পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে ড্রেজিংয়ের কথা তুলে ধরা হতে পারে। এর আগে কল্যাণ রুদ্র দুই দফায় সমীক্ষা করে মমতা ব্যানার্জির কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে নদীর প্রবাহের জন্য পানি ধরে রাখার সুপারিশ করেন।
তিস্তার পানির ২০ শতাংশ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য ছেড়ে দিয়ে ৪০ : ৪০ অর্থাৎ অবশিষ্ট পানি বাংলাদেশ ও ভারত সমান ভাগ করে নেবে বলে চূড়ান্ত করা হয়েছিল (২০১০-২০১১) সালে তৎকালীন ড. মনমোহন সরকারের আমলে। এটি এখন এমন অবস্থায় আছে, যেকোনো সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব। যৌথ নদী কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্যের মতে, এমন পরিস্থিতিতে আবার নদী খনন বা পানিপ্রবাহের কথা আলোচনায় নিয়ে আসা সময়ক্ষেপণেরই নামান্তর। তবে মমতা ব্যানার্জি সহজে যে তার মতামত তিস্তা বিষয়ে চাপিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করবেন না, তা বাংলাদেশের মানুষ যত দিন যাবে ততই ক্রমবর্ধিতভাবে টের পাবে তা মোটামুটি স্পষ্ট। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা এ উপমহাদেশের মানুষের মঙ্গল সাধন করুন।
লেখক : সাবেক সচিব; ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চুক্তির (১৯৯৯) খসড়া প্রণয়নে সরকার গঠিত কমিটির দলনেতা
সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১ এপ্রিল ২০১৮