[৩১ মার্চ ২০১৮, জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে “নিকলীর ওসি নাসিরউদ্দিন একের পর এক বিতর্কে” শিরোনামে প্রকাশিত নিকলী থানা ওসি’কে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আমাদের নিকলী ডটকম পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।]
নাসরুল আনোয়ার, হাওরাঞ্চল ।।
‘আমরা গরিব মানুষ। আমরা কি আর হেরার লগে ফারুম!’ কালের কণ্ঠকে বলছিলেন মাজেদা বেগম। আঞ্চলিক ভাষায় ‘হেরা’ অর্থ ‘তারা’ এবং মাজেদা বেগম স্থানীয় পুলিশ তথা ওসির নির্যাতনে অসহায় বোধ করার কথা বোঝাচ্ছিলেন। কিশোরগঞ্জের নিকলী থানার ওসি মো. নাসিরউদ্দিন ভূঞার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আরো অনেকের। অনেকেই বলছে, ওসির ক্ষমতার ‘অপব্যবহারের’ কারণে অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছে, পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
জানা গেছে, ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ওসি দাপ্তরিক কাজে ছাতিরচরে যাওয়ার উদ্দেশে নিকলীর চন্তিখালী খেয়াঘাটে পুলিশ পাঠান। কিন্তু মাঝি আব্দুল কাদির (৩৪) জানান, প্রত্যন্ত হাওরের ছাতিরচর ইউনিয়নে তিনি যেতে চান না। তিনি অন্য একটি ট্রলার ঠিক করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। শুনে ওসি থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) কায়সারকে বলেন কাদির মাঝিকে ধরে আনতে। খেয়াঘাটের এই মাঝির স্ত্রী মাজেদা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ তাঁর স্বামীকে থাপ্পড় দিতে দিতে ওসির সামনে নিয়ে গিয়েছিল। মাজেদা দাবি করেন, তাঁর স্বামীকে সেদিন ওসি নিজেও মারধর করেন এবং পুলিশভ্যানে তোলার নির্দেশ দেন। উপস্থিত কিছু কৃষকের অনুরোধে ওসি শান্ত হন এবং কাদিরও পুলিশের দলটিকে ছাতিরচর নিয়ে যেতে বাধ্য হন। জানা যায়, নির্যাতিত মাঝির গ্রাম পূর্বগ্রামের অনেক মানুষ খবর পেয়ে সন্ধ্যায় নিকলী নতুন বাজারে প্রতিবাদ মিছিল করতে জড়ো হয়েছিল। সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. কফিল উদ্দিন এসে মীমাংসার আশ্বাস দিয়ে তাদের শান্ত করেন। মাজেদা বেগম বলেন, পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় নিকলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কারার সাইফুল ইসলাম তাঁর প্রতিষ্ঠান স্পন্দন ললিতকলা একাডেমিতে সালিস ডাকেন। সালিসে ওসি সবার সামনেই কাদির ও তাঁর বৃদ্ধ বাবা আব্বাস আলীর কাছে ‘ভুল শিকার’ করেন।
ওসির বিরুদ্ধে আরো যেসব অভিযোগ শোনা যায় এর মধ্যে আছে এক স্কুলছাত্রী অপহরণের ঘটনায় মামলা না নেওয়া এবং অপহৃত অবস্থায় মেয়েটির সঙ্গে একাধিকবার দেখা হওয়ার পরও তার উদ্ধারে ব্যবস্থা না নেওয়া। আদালতে মামলার পর একপর্যায়ে মেয়েটি উদ্ধার হয়। সে পরিবারকে বলে, তার আটকাবস্থায় ওসি গিয়ে তিনবার দেখা করেছেন; কিন্তু উদ্ধারের চেষ্টা করেননি।
ওসির বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, স্রেফ নিজের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় তিনি থানার আধাকিলোমিটার দূরের মাহফিল অনুষ্ঠান থেকে ষাটধার গ্রামের সাত ও ৯ বছর বয়সী দুটি শিশুকে থানায় ধরে আনেন এবং জঙ্গি হিসেবে চালান করে দেওয়ার হুমকি দেন। প্রতিবাদে এলাকাবাসী থানার সামনে জড়ো হলে পুলিশ শিশু দুটিকে ছেড়ে দেয়।
এ ছাড়া ওসি উপজেলার সিংপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ারুল হকের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির একটি সভায় প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহার করেন। পরে চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নিকলীর ওসির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া গত ৫ জানুয়ারি নিকলীতে বিএনপির নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশ চড়াও হয় এবং তাদের অ্যাকশনের সেই ছবি একটি জাতীয় দৈনিকের নিকলী প্রতিনিধি খাইরুল মোমেন স্বপন তোলেন। ওই দিন দুপুরেই ওসির নেতৃত্বে এক দল পুলিশ থানা কমপ্লেক্সের কাছে অবস্থিত সাংবাদিক স্বপনের বাসায় হানা দেয়। স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, সেদিন তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের অকথ্য গালাগাল করেন ওসি।
উঠেছে সিমেন্ট চাঁদাবাজিরও অভিযোগ। জানা যায়, নিকলী থানা চত্বরের বাগানের কাজ চলাকালে একজন এএসআই নিকলীর বিভিন্ন সিমেন্টের দোকানে গিয়ে ওসির বরাত দিয়ে সিমেন্ট চান। পরে চারজন সিমেন্ট ব্যবসায়ী দুই বস্তা করে সিমেন্ট দেন। দোকানগুলো হচ্ছে মেসার্স জাহাঙ্গীর ট্রেডার্স, অর্পা ট্রেডার্স, মায়া ট্রেডার্স ও নিলুফা ট্রেডার্স। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর ট্রেডার্সের মালিক মো. জাহাঙ্গীর মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁর দোকান থেকে ওই এএসআইকে দিয়ে ওসি সাহেব মোট আট বস্তা সিমেন্ট নিয়েছেন। এর মধ্যে দুই বস্তা নিয়েছেন চাঁদা হিসেবে ও বাকি ছয় বস্তা টাকায়। এ ছয় বস্তার মধ্যে তিন বস্তার টাকা পরিশোধ করলেও ওসি বাকি তিন বস্তার টাকা দেননি।’
ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর মিয়া আরো বলেন, ‘মসজিদের কাজ হলে আমরা এমনিতে সিমেন্ট দিয়ে দিই। কিন্তু থানার কাজের জন্য কোনো দিন এভাবে সিমেন্ট নিতে শুনিনি। থানার উন্নয়নের জন্য ফান্ড আছে। কিন্তু ওসির বরাত দিয়ে আমাদের কাছে সিমেন্ট চাওয়ায় আমরা না দিয়ে পারিনি। তবে অতীতে আর কোনো ওসিকে এমন কাজ করতে দেখিনি।’
ওসির যত জবাব : গত শনিবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে ওসি নৌকার মাঝিকে মারধর করার অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ রকম কিছু মনে পড়ছে না।’ স্কুলছাত্রী অপহরণের ঘটনায় থানায় মামলা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আদালতে তো মামলা হয়েছে!’ একজন অপহৃতার সঙ্গে গোপনে তিন দফা সাক্ষাতের বিষয়টি অস্বীকার করে ওসি বলেন, ‘অপহৃত অবস্থায় কথা হয় কিভাবে!’ শিশুদের ধরে নিয়ে ‘জঙ্গি’ বানিয়ে দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে ওসি বলেন, ‘ওরা মাইকে উচ্চ স্বরে কথাবার্তা বলছিল, গজল গাইছিল। এটা পাবলিক ন্যুইসেন্স। মানুষ অভিযোগ করায় শিশুদের অভিভাবকদের মুচলেকা নেওয়ার জন্যই সবাইকে থানায় এনেছিলাম, খারাপ কোনো উদ্দেশ্যে নয়।’ বাচ্চাদের অকথ্য গাল দেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের বকা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ ওসি দাবি করেন, ‘মানুষের মঙ্গলের জন্যই কাজ করি।’
থানার উন্নয়নকাজের জন্য ‘চাঁদা’ হিসেবে প্রতি দোকান থেকে দুই বস্তা করে সিমেন্ট আদায়ের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য, ‘থানার উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সিমেন্ট কিনে নিচ্ছি। বিনা টাকায় নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!’
গত শনিবার সন্ধ্যায় ওসির সঙ্গে কালের কণ্ঠ’র কথা হয়। পরে রাতে জানা যায়, সন্ধ্যার পরই তিনি তড়িঘড়ি করে সিমেন্টের টাকা পরিশোধ করে দেন। কয়েকজন সিমেন্ট ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে জানান, সন্ধ্যার পর নিকলী থানার এক এএসআই দোকানে দোকানে গিয়ে ওই টাকা পরিশোধ করে আসেন। সিমেন্ট ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘ফ্রিতে নেওয়া দুই বস্তার সঙ্গে বাকিতে নেওয়া আরো তিন বস্তার টাকাই একজন এএসআই দিয়ে গেছেন। অন্য ব্যবসায়ীরাও সেই টাকা ফেরত পেয়েছেন।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বাজিতপুর সার্কেল) মোহাম্মদ কামাল উদ্দিনের সঙ্গে নিকলীর ওসির বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ নিয়ে গত সপ্তাহে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানান, এ ধরনের কিছু অভিযোগ তাঁদের কানেও গেছে এবং এ বিষয়ে তিনি নিকলীতে ‘ওপেন হাউস ডে’ করে নিকলীবাসীর কথা শুনতে চান। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষায় এটি জরুরি। ওসির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে যথারীতি বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গতকাল যোগাযোগ করা হলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, দাপ্তরিক কাজে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। দুই দিন পর ফিরে এসেই নিকলীতে ‘ওপেন হাউস ডে’ পালনের তারিখ চূড়ান্ত করবেন।