আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
বিশ্বের জনসংখ্যার অন্তত অর্ধেক এখনও অপরিহার্য স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর পূর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আর স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে প্রতি বছর চরম দরিদ্র হয়ে পড়ছে ১০ কোটি মানুষ। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ অর্থাৎ ৮০০ মিলিয়ন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের পরিবারের বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ ব্যয় করতে হয়।
যদিও ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিধি (ইউএইচসি) অর্জনের বাধ্যবাধতকা রয়েছে। সংস্থাটির মতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিধি কোনো একক বিষয় নয়।
এমনকি বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়ও নয়। মানব স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিধি হল স্বাস্থ্যের সব অনুষঙ্গ সবার জন্য নিশ্চিত করা- যা অবশ্যই দেশের প্রত্যেকটি মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী হবে।
টেকসই সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে কাউকে যেন আবার দেউলিয়া হতে না হয়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সব উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা সরবরাহ, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যের সুবিধাগুলো এবং যোগাযোগে নেটওয়ার্ক, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, তথ্য ব্যবস্থা, গুণমান নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়া এবং সর্বোপরি এ সংক্রান্ত শাসন ও আইন। সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিধি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবা নয়।
এটি জনসংখ্যাভিত্তিক সেবা। পাবলিক হেলথ ক্যাম্পেইন যেমন- বিশুদ্ধ খাবার পানি নিশ্চিত করা, মশার প্রজনন ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করা, নিরাপদ পয়োঃব্যবস্থা নিশ্চিত করা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।
অর্থাৎ সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিধিতে রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের প্রতি যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, একই সঙ্গে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশও নিশ্চিত করার প্রতি সমান গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৫৫ ভাগ মানুষ এখনও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এসব মানুষের সেবার প্রধান মাধ্যম এলাকার ওষুধের দোকানদার, কোয়াক ডাক্তার এবং নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা। অর্থাৎ এরা কেউই নিবন্ধিত চিকিৎসকের সেবা পান না। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই এই ৫৫ ভাগ মানুষের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তা গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের মোট ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়।
ফলে প্রতি বছর ৫ শতাংশ মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে- যা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পরিপন্থী। সর্বোপরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে কাউকে যেন পকেট থেকে ব্যয় করতে না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
তবে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মতে, দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের সফলতা আশাব্যঞ্জক। সরকার বর্তমানে জিডিপির ২.৮ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭১ দশমিক ৮ বছর। এটা ২০০০ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ৫ বছর। শিশুদের টিকা দানের অর্জন ৯৪ শতাংশ।
অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে ৬৫ শতাংশ মানুষকে। মাতৃ মৃত্যুর হার এখন প্রতি লাখে ১৭৬ জন, যা ২০০০ সালে ছিল ৩৯৯ জন। প্রতি ১০০০ জনে নবজাতকের মৃত্যু ২০০০ সালে ছিল ৪২ দশমিক ৬, যা ২০১৫ সালে কমে ২৩ দশমিক ৩-এ দাঁড়িয়েছে।
২০০০ সালে পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৮৮ জন, যা ২০১৫ সালে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৬। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, দেশে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গভাবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে মানুষের পকেট থেকে যেন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আশা করছি ২০৩০ সালের মধ্যে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এ ক্ষেত্রে সর্বস্তরে স্বাস্থ্য বীমা চালু করতে হবে এবং সেটা আবশ্যই সরকারের তত্ত্বাবধানে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত জিওগ্রাফিক কাভারেজ নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থাৎ দেশের সর্বত্র যেন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, গুণগত মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, এ সেবা নিতে গিয়ে যেন কাউকে দরিদ্র হতে না হয়।’
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা না হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে প্রতি বছর ৭ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০১৮ উদ্যাপন উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা : সবার জন্য, সর্বত্র’। এ বছর দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সেমিনার, জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র, স্মরণিকা প্রকাশ, টেলিভিশনে আলোচনা অনুষ্ঠান, সড়কদ্বীপ সজ্জিতকরণ, প্রেস ব্রিফিং, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, জারিগান, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আলোচনা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এ বছর জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শনিবার (৭ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকাস্থ ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে তিনি জনসাধারণের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বরোপ করেছেন।
সূত্র : চিকিৎসা নিয়ে বছরে গরিব হচ্ছে ১০ কোটি মানুষ [যুগান্তর, ৭ এপ্রিল ২০১৮]