ভারতের নদীসংযোগ প্রকল্প ও ট্রানজিট নিয়ে তোড়জোড়

karar mahmudul hasan nikli

কারার মাহমুদুল হাসান ।।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশের আমজনতা এ আশায় অপেক্ষমাণ ছিল যে, কংগ্রেস সরকারের কয়েক দশকব্যাপী দৃশ্য ও অদৃশ্য বিভিন্ন ছলচাতুরীর বাইরে অবস্থান নিয়ে হয়তো বা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদানের ব্যবস্থা ভারত করবে। একই সাথে ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে পানিশূন্য না করার আকাক্সক্ষার বাস্তব ও মানবিক পদক্ষেপ নেবে। বিতর্কিত ‘তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সংকোষ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প’ নিয়ে আর সামনে এগোবে না। একই সাথে, সীমান্তে প্রায় হররোজ সাধারণ মানুষজনকে নির্বিবাদে বিএসএফ কর্তৃক গুলি করে হত্যা করার নির্মম ‘কর্ম’গুলো চূড়ান্ত ও সার্বিকভাবে বন্ধ করার লক্ষ্যে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে মোদি সরকার। এ ছাড়া পলিমাটির এ বাংলাদেশের নিরন্তর ভঙ্গুর সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে ভারতের পূর্বাংশ থেকে পশ্চিমাংশে এবং উল্টো পথে সে দেশের ২০-৩১-৪০-৫০ টনি লরিতে মালামাল বহনে ‘ইকুইট্যাবল’ অর্থাৎ মালামালের প্রকৃত ওজন যথাযথভাবে বিবেচনায় এনে সংশ্লিষ্ট সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের এবং সাংবৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মালামাল পরিবহন বিবেচনায় আনুপাতিক হারে জোগান দেয়ার বিষয়ে ভারত বাংলাদেশের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরে এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশের ‘১৬ কোটি’ মানুষ এ আশায় বুক বেঁধেছিল যে, মোদির এ সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরো নিবিড় করবে ও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
২৬ মে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঘোষণায় বলা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির আসন্ন সফরের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ভারতের সম্পৃক্ততার গুরুত্ব প্রতিফলিত হচ্ছে। ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তরিক ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার এবং মৈত্রী ও বিশ্বাসের বন্ধন শক্তিশালী হবে’ বলে আশার কথাও জোরেশোরে বলা হলো। একই তারিখে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও প্রায় একই ধরনের ঘোষণায় অভিমত ব্যক্ত করে যে, মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের চমৎকার সম্পর্ক আরো জোরদার এবং সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব দিক নিয়ে আলোচনা হবে। এতে আরো বলা হয়, মোদির সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে ভারতের সাথে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করতে কাজ করছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া ওই সময় অর্থাৎ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোদি তার ঢাকা সফরে বাংলাদেশীদের জন্য বেশ কিছু ‘চমকপ্রদ’ ঘোষণা দিতে পারেন। এর একটি হতে পারে, ভারতের কিছু বিমানবন্দরে বাংলাদেশীদের জন্যও আগমনী ভিসা চালু করা। বর্তমানে বেশ কিছু দেশ এ সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ এর বাইরে রয়েছে।
প্রায় ৪০ ঘণ্টার সফরে নরেন্দ্র মোদি ৬ জুন ঢাকা এলেন এবং মূলত অনেকের ধারণা, প্রায় সার্বিক ‘লাভ-ক্ষতির’ বিবেচনায় ভারতের স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন, অভ্যন্তরীণ নৌ প্রটোকল নবায়ন, সমুদ্র অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবেলা, শিক্ষা, সংস্কৃতি খাতে সমঝোতা স্মারক এবং নতুন দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। এ সফরের অনেকগুলো চুক্তির মধ্যে আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, নৌ ও সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি বিষয়ক বড় বড় মাপের চুক্তি ছাপিয়ে যে খবরটি গত বেশ কয়েক সপ্তাহব্যাপী আসছে, সেটি হলো- গুচ্ছগ্রামগুলো নিজ নিজ ইচ্ছায় দুই স্বাধীন দেশে যোগদান নিয়ে আনন্দ উৎসব-উল্লাস, সভা-সমাবেশ, গানবাজনা, লাঠিখেলা ইত্যাদির আয়োজন করেছে। মূলত বাংলাদেশ এবং সেই সাথে পশ্চিমবঙ্গ-কুচবিহার অংশে বেশ কিছু দিন ধরে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে গত ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটের পর থেকে এটি হয়ে এসেছে। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা ও আগের বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি দুই দেশ ৪০ : ৪০ শতাংশ এবং নদীর মধ্যে সব সময় ২০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রেখে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ড. মনমোহন সিংয়ের ২০১১ সালে ঢাকা সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাগড়ার দোহাই দিয়ে সেই চুক্তিকে হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়ে ড. মনমোহন ঢাকা সফরের সমাপ্তি টানেন।
এর প্রায় চার বছর পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অর্ধশতাধিক সফরসঙ্গী নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দিনের সফরে ঢাকা মাতিয়ে যান। শিল্পী, গায়িকা, কবি, সাংবাদিক ও রবীন্দ্রভক্ত, কর্মহীন বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন বয়সী মুখচেনা গুণমুগ্ধদের সাথে আনন্দঘন আড্ডা-গল্পগুজবে অনেক সময় কাটিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আনুষ্ঠানিক সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। শিগগিরই তিস্তার পানির হিস্যা বিষয়ে দুই দেশের ঐকমত্য-ভিত্তিক সমঝোতা চুক্তির ‘আশাবাদ’ হাসিমুখে জানান দেয়ার পর মমতা বাংলাদেশের ইলিশ মাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পাচ্ছেন না মর্মে শেখ হাসিনা বরাবরে অনুযোগ জানিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, ড. মনমোহন সিং তিস্তার বিষয়ে সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তিস্তার পানি ভাগাভাগির জন্য প্রস্তুতকৃত চুক্তিটি সামান্য রদবদল করে ভারত-বাংলাদেশ ৫২ : ৪৮ অনুপাতে তিস্তার পানি বণ্টনের পুনঃসিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু মমতার তৃণমূলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীনেশ বাবু এ ফর্মুলার তুমুল বিরোধিতা করে বলেন যে, বাংলাদেশকে কোনোক্রমেই ২৫ শতাংশের বেশি পানি দেয়া চলবে না। গত ৬৮ বছর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারত সরকার বাংলাদেশ ও সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের কল্যাণ হোক, সে বিষয়ে কখনো সুস্থ চিন্তাভাবনাপ্রসূত (নিজেদের লাভ ছাড়া) কোনো বিষয়ে এগিয়ে এসেছে, তার প্রমাণ দিতে পেরেছে কি না তা এখনো বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন বটে। ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ গত ৯ এপ্রিল ডিক্যাব আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া’ অনেক মূল্যবান কথা বলেন, যা ঢাকার একাধিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করে। এসব খবর ছিল নিম্নরূপ : ‘তিস্তার সমাধান খুঁজে পেতে দুই দেশের অপেক্ষা করা উচিত’, ‘দুই পক্ষ একমত হলেই তিস্তাচুক্তি’, ‘গ্রহণযোগ্য তিস্তা চুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে’ ইত্যাদি। তিনি দেরিতে হলেও ভারত (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসহ) তাদের সুপ্ত বাসনাগুলো রাখঢাক না রেখেই প্রকাশ করেছেন। পঙ্কজ শরণের বক্তব্যের সারকথা হলোÑ শুধু বাংলাদেশ ও ভারত নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য সম্পদ হিসেবে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। তাই মূল্যবান এ সম্পদের ‘সর্বোচ্চ’ সদ্ব্যবহারের উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং আগামীতে ‘দুই’ পক্ষ একমত হলেই তিস্তা ইস্যুর সমাধান হবে। কী সুন্দর চাতুর্যময় কথা ও আশ্বাসবাণী!

তিস্তা নিয়ে নতুন খেলা!
নরেন্দ্র মোদির সফরের দুই-আড়াই সপ্তাহ পার না হতেই নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্র থেকে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বলা হচ্ছে- ‘তিস্তায় আগে খনন, পরে চুক্তি’। এ বিষয়ে নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে ইঙ্গিতও দেয়া হয় ঢাকাকে। আরো বলা হয়, নদীতে পানি না থাকলে বণ্টন-চুক্তি কারো জন্যই লাভজনক হবে না। তাই যৌথভাবে তিস্তা নদী খননের জন্য ব্যবস্থা নেয়া জরুরি এবং ভারতীয় পক্ষের পানির সমবণ্টনের বিষয়েও আপত্তি আছে। অথচ নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরের আনুষ্ঠানিক বৈঠকসহ কোনো পর্যায়েই বণ্টনের পরিমাণ সম্পর্কে কোনো ধরনের মন্তব্য করেননি। তবে ভারত এখন এ নিয়েই কালক্ষেপণ করে যাবে। মোদি নাকি শেখ হাসিনার সাথে ঢাকায় আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিংয়ে দেয়া বক্তব্যে নদীর ‘পরিচ্ছন্নতা’র কথা বলেছিলেন। তবে তিস্তা নদী খননের বিষয়ে কিছু বলেননি। কথার মারপ্যাঁচে ‘পরিচ্ছন্নতা’ আর ‘খনন’ সমার্থক হয়ে গেল কিভাবে- ভাবতে কষ্ট লাগে, তবে অবাক হই না। বাংলাদেশের জন্য আরো খবর হলো, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা অতি সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলতে গিয়ে জানালেন, তিস্তা ইস্যুর বিষয়ে তিনি এখন কোনো কথাই বলবেন না। কারণ, এটি সার্বিকভাবে কেন্দ্রীয় ভারত সরকার আর বাংলাদেশ সরকারের আয়ত্তাধীন বিষয়। অথচ ২২ ফেব্রুয়ারি মমতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকায় বসে তিস্তার পানি বণ্টনের ন্যায্য চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন। গত ১৮ আগস্ট দূরদর্শনের খবরে জানা গেল, মমতা আসলে বন্যা ও অন্যান্য প্রকল্পে ২১ হাজার রুপি কেন্দ্র থেকে পাওয়ার দেনদরবারে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু তিস্তা আলোচনা ছিল অনুপস্থিত।’

বাংলাদেশকে ‘মহাশ্মশান’ করার আয়োজন
ভারতজুড়ে আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে, তারই অংশ হিসেবে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যেও তিস্তা-গঙ্গা-মানস-সংকোষ নদীসংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে ভারতের পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয় গত ১৩ জুলাই। এ দিকে দেশটির পানিসম্পদ মন্ত্রী সানোয়ার লাল জাট জানিয়েছেন, তার মন্ত্রণালয় আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকারের সাথে আলোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদীসংযোগ প্রকল্প ‘মানস-সংকোষ-তিস্তা-গঙ্গার কাজ শুরু করবে। তিনি আরো বলেছেন, এ সংযোগ প্রকল্প শুধু এ অঞ্চলের কৃষি ও পানিপ্রাপ্যতাকেই সহজ করে তুলবে না, একই সাথে তা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিপুল পানি চালান করবে। (দৈনিক ইত্তেফাক ২২-৭-২০১৫)। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানালেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে খুব দ্রুত চিঠি পাঠাচ্ছেন তিনি। লক্ষ করার বিষয়, পূর্ববর্তী মনমোহন সরকার বাংলাদেশের সরকারকে বারবার এ আশ্বাসই দিচ্ছিল যে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এবং বাংলাদেশের কোনো রকম অসুবিধার কারণ, এমন কোনো কার্যক্রম ভারত সরকার আদৌ গ্রহণ করবে না। মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের এ বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞাত থাকার কথা। তিনি চিঠি লেখালেখি করে কালক্ষেপণ না করে জরুরি ভিত্তিতে ভারত সফরে গিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনে নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাৎ করে জানতে চাওয়া উচিত, এ ধরনের অন্যায় ও বাংলাদেশের জন্য জীবন-মরণ কর্মকাণ্ড বন্ধে ভারত ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন, যে বিষয়ে পূর্ববর্তী কেন্দ্রীয় সরকার বারবার বাংলাদেশ সরকারকে উচ্চতম পর্যায়ে আশ্বাস দিয়েছে।
ভারতের ন্যাশনাল ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি প্রায় ২০ বছরের পর্যবেক্ষণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩৮টি নদীসহ বিভিন্ন নদীর মধ্যে ২৯টি সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনার বিশেষ দিক হচ্ছে, নদীর এক অববাহিকার উদ্বৃত্ত পানি অন্য অববাহিকায় যেখানে ঘাটতি রয়েছে, সেখানে স্থানান্তর করা। এই ২৯টি সংযোগ খালের মধ্যে ১৩টি হিমালয়বাহিত আর ১৬টি বিভিন্ন নদী ও উপদ্বীপ থেকে উৎসারিত। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারত সারা দেশে ৭৪টি জলাধার ও বেশ কিছু বাঁধ নির্মাণ করবে। ফলে বর্ষার সময় সঞ্চিত পানি শুকনো মওসুমে বিভিন্ন স্থানে কৃষি ও অন্যান্য কাজে সরবরাহ করা হবে। তারই অংশ হিসেবে এ নদীসংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন ভারতের মন্ত্রী। পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পত্রিকার খবরকে ভিত্তি করে ভারতের কাছে ‘প্রতিবাদ’জাতীয় কর্মকাণ্ড গ্রহণে অপারগ মর্মে জানিয়ে দিয়েছেন।

saroni_karar_mahmudul_hasan
অন্য দিকে বাংলাদেশের পানিবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সংযোগ খালের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশ কার্যত মরুভূমিতে পরিণত হবে। মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের শাখা নদীগুলোর পানিপ্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে। আর জলাভূমিগুলোও শুকিয়ে যাবে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমে গেলে লবণাক্ততা দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত উঠে আসতে পারে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে ইতোমধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ক্রমেই বাড়ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত জুন মাসে প্রথম বাংলাদেশ সফরে ৪১ বছর আগের মুজিব-ইন্দিরা গুচ্ছগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নকল্পে নতুন করে চুক্তি সম্পাদন ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতের সাথে যে ২২টি চুক্তি, চুক্তি নবায়ন, মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং তথা সমঝোতা ইত্যাদি সম্পাদন হয়েছে, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্য অক্ষরিক অর্থেই প্রায় ৯০ শতাংশ লাভজনক মর্মে প্রতীয়মান ট্রানজিট (সংশ্লিষ্ট উপকারকাক্সক্ষীরা ‘কানেক্টিভিটি’ নামে অভিহিত করছেন) চুক্তি। আর এ চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে ভারতের পক্ষ থেকে যে তোড়জোড় আহ্বান উপদেশ তাগিদ ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে, তা বেশ দৃশ্যমান এবং ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টিকটুও মনে হয়। তিস্তার পানির বেলায়, বাংলাদেশ নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত ব্যবস্থা অমান্য করে এ দেশের প্রাপ্য অধিকারকে আরো এক বা একাধিক দশক পিছিয়ে দেয়ার কারসাজির বিষয়ে তারা কোনো কথা বলছেন না। ট্রানজিট চুক্তির জন্য ভারত সেই ১৯৪৭ সাল থেকে এবং কার্যকরভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষমাণ ছিল, যা সম্প্রতি সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছে। ট্রানজিট, যার নতুন নাম দেয়া হয়েছে ‘কানেক্টিভিটি’- বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার পাঁচ-ছয় বছর আগে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি ‘কোর কমিটি’ গঠন করেছিল। সেই কোর কমিটির পেশকৃত সমীক্ষা প্রতিবেদনে (২০১১) সংশ্লিষ্ট সড়ক-মহাসড়ক, রেল ও বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে (মূলত ভারতের সেভেন সিস্টারস রাজ্যগুলো থেকে বাংলাদেশের পশ্চিমাংশে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মালামাল পরিবহন সুগমকরণার্থে) প্রাথমিক হিসাবে ৪৭ হাজার ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন মর্মে মতামত দেয়া হয়। তবে পাশাপাশি ট্রানজিট-সংক্রান্ত অবকাঠামো তৈরির জন্য অর্থায়নে ঝুঁকি নিয়েও সতর্ক করেছে ওই কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের আওতায় আশানুরূপ পণ্য পরিবহন না হলে আর বিনিয়োগের অর্থ যদি বিদেশী সংস্থার কাছ থেকে নেয়া হয়, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এই বিপুল বিনিয়োগের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাজেটের মাধ্যমে সম্পূর্ণ দেশজ অর্থায়নে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে অন্যান্য আর্থসামাজিক উন্নয়নসংক্রান্ত প্রকল্পে ব্যয় সঙ্কোচন হবে। এতে ‘সুযোগ ব্যয়’ আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই ট্রানজিট-সংক্রান্ত প্রকল্পে বিনিয়োগের বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।
কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট চুক্তিটি সব পক্ষের জন্যই লাভজনক হওয়া প্রয়োজন। তবে বিনিয়োগ কত দিনে উঠে আসবে, তা নির্ভর করছে কী পরিমাণ পণ্য ও যানবাহন আসা-যাওয়া করবে তার ওপর। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত, আমলা, প্রকৌশলী ও অন্যদেরকে সংশ্লিষ্ট কাজগুলো সম্পাদনের জন্য এখনই ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ এবং সেই সাথে নেপাল-ভুটানের আমদানি-রফতানির যে চিত্র বিভিন্ন তথ্যমাধ্যম থেকে পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, বিশেষত ভারতের সাথে এবং পাশাপাশি কম-বেশি করে হলেও নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির পার্থক্য বিশাল। নিচের ছক দেখুন।
উপরিউক্ত তথ্যাদি পর্যালোচনায় কথিত চার দেশী ট্রানজিটের আওতায় বাংলাদেশের বিপুল সুবিধা পাওয়া এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা প্রচার করা হচ্ছে।
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, ট্রানজিট চালুর প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ কী পরিমাণ সুবিধা পাবে, তা এসব সাম্প্রতিক বাণিজ্যের পরিমাণই বলে দিচ্ছে। আর সে জন্য বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জনগোষ্ঠীর গুরুতর আশঙ্কার কারণ, সম্প্রতি ভারতের ঢাকা হয়ে শুরু হয়ে যাওয়া বাস তথা যাত্রী চলাচলের মহড়ার পর এক বা দুই বছরের মধ্যে সেভেন সিস্টারস থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে এবং উল্টো দিকে যে হিমালয়সম পণ্য মালামাল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পরিবাহিত হবে, সে বিষয়ে আমরা কোনো চিন্তাভাবনা শুরু করেছি কি না তাই এখন বড় প্রশ্ন।
এ দিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ ঝানু রাজনীতিকদের মতো গত ৩ আগস্ট এফবিসিসিআইয়ের মধ্যাহ্নভোজে ভারতের ১২০ কোটি মানুষের বিশাল বাজারের দিকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের নজর দিতে নসিহত করেছেন এবং ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল মর্মে উল্লেখ করে বলেছেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কম হওয়ার ক্ষেত্রে সীমান্ত অবকাঠামোর সমস্যাটিও বড়। তার মতে, বাংলাদেশের সীমান্ত অবকাঠামো, অর্থাৎ সড়ক-মহাসড়ক, বন্দর ইত্যাদি আরো উন্নত করতে হবে। আর কাজগুলো বাংলাদেশকেই করতে হবে। কী মনোমুগ্ধকর এবং সেই সাথে কী গুরুতর উপদেশ।
লেখক : সাবেক সচিব ও প্রেসিডেন্ট, চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিক্স অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট বাংলাদেশ

সূত্র : ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫, নয়া দিগন্ত

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!