আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কিলিয়ান এমবাপের জীবনে অনেক কিছু ঘটে গেল। বিশ্বকাপের ‘শেষ ১৬’ রাউন্ডের নকআউট পর্বে আর্জেন্টিনাকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে ফ্রান্সের কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার নায়ক হয়ে গেলেন ১৯ বছর বয়সী এই ফুটবল তারকা।
তার এই উত্থানে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র তিন বছর আগে তিনি হাই স্কুলে তার লেখাপড়া শেষ করেছেন। তারপর দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন একজন পেশাদার ফুটবলার। ফ্রান্সের জাতীয় দলের খেলোয়াড়।
বর্তমানে তিনি ‘লোনে’ খেলছেন ফরাসী ক্লাব প্যারিস সঁ জার্মেইনের হয়ে। এর মধ্যে তিনি দু’বার ফরাসী লীগ জিতেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এখন এই প্যারিস সঁ জার্মেইন ক্লাবে স্থায়ীভাবে খেলার ব্যাপারে তার সাথে ১৮ কোটি ইউরোর একটি চুক্তি হতে পারে।
রাজধানী প্যারিসের উত্তর-পূর্ব শহরতলিতে বেড়ে ওঠার সময় ফুটবলে দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করেন তিনি। সেসময় তিনি খেলতেন এএস বন্ডি ক্লাবে।
এমবাপে খেলা শুরু করার পর হু হু করে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এই ক্লাবের। একই সাথে অল্পবয়সী ছেলেরাও ভিড় করতে শুরু করে এই ক্লাবের হয়ে খেলার জন্যে। তাদের স্বপ্ন যে তারাও একটি এমবাপের মতো ফুটবলার হবেন।
একেবারে শিশু বয়সে এমবাপে যে ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেছিলেন বিবিসি স্পোর্টসের সাংবাদিকরা সেখানে গিয়েছিলেন। কথা বলেছেন, এমবাপেকে যারা চেনেন তাদের সাথে।
‘ফুটবলার হিসেবেই কিলিয়ানের জন্ম’
মাত্র তিন মাস আগে পর্যন্তও এমবাপের পিতা উইলফ্রিড ছিলেন এএস বন্ডি ক্লাবের পরিচালকদের একজন। এই ক্লাবটিতে খেলে বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা। তাদের জন্যে আছে আলাদা আলাদা গ্রুপ- অনূর্ধ ১০, অনূর্ধ ১৭। এমবাপের পিতা এই ক্লাবের সাথে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে জড়িত ছিলেন।
এএস বন্ডি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আতমানে এরুশ : “আপনি বলতে পারেন যে এখানে এই ক্লাবেই এমবাপের জন্ম হয়েছে। তার বাবা যখন এই ক্লাবেরই একজন খেলোয়াড় এবং কোচ ছিলেন তখন থেকেই শিশু এমবাপে এই ক্লাবের সাথে আছে। সে সবসময়ই এখানে ছিল। ফুটবল খেলা সে এখানেই শিখেছে, এমনকি তার বাচ্চা বয়সেও।”
“আমরা যখন খেলতাম, খেলা শুরু হওয়ার আগে দেখতাম, দুবছর বয়সী একটি বাচ্চা একটি বল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে আমাদের সাথে বসে থাকতো, টিমের সদস্যরা যখন আলোচনা করতো সেসব সে চুপ করে মন দিয়ে শুনতো। আমার ধারণা, খেলা শুরু হওয়ার আগে দলের ভেতরে যেসব আলোচনা হয় সেসব কথাবার্তা তার মতো হয়তো আর কেউই শোনেনি।”
এএস বন্ডি ক্লাবের অনূর্ধ ১৩ গ্রুপের কোচ আন্তোনিও রিকার্ডি : “তার বাবা আমার দ্বিতীয় পিতার মতো। ফলে আমি কিলিয়ানকে শিশুকাল থেকেই চিনি। কোচ হিসেবে তাকে যখন প্রথম ফুটবল খেলা শেখাই তখন তার বয়স ছিল ছয় বছর। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম সে আর সবার চেয়ে আলাদা ছিল।”
“অন্য বাচ্চারা যা করতে পারতো, কিলিয়ান তারচেয়েও বেশি করতো। তার ড্রিবলিং ছিল অসাধারণ। আর অন্যদের চেয়েও সে খুব দ্রুত গতিতে দৌড়াতে পারতো।”
এরুশ : “ফুটবল আর খেলার মধ্যেই তার জন্ম। তার পিতা ছিলেন ফুটবলের একজন তরুণ নেতা। স্থানীয় এলাকায় তিনি শিশুদের নিয়ে কাজ করতেন। তখন তাকে এএস বন্ডি ক্লাবে নিয়ে আসা হয়। মাত্র তিন মাস আগে তিনি ক্লাব ছেড়েছেন। কিন্তু তিনি যা করেছেন সেটা এই ক্লাবে চিরকাল থাকবে। তিনি তার জীবনের ২৫ বছর এই ক্লাবের জন্যে দিয়েছেন। কিলিয়ানের মায়ের ভূমিকাও আছে। তিনিও খুব ভালো পেশাদার হ্যান্ডবল খেলোয়াড় ছিলেন।”
‘তার ঘরে ছিল রোনালদোর পোস্টার’
তার বয়স যখন ১২ থেকে ১৫ তখন তিনি বিখ্যাত ক্লেয়ারফন্টাইন একাডেমিতে ফুটবল খেলা শিখেছেন। তার আগে তিনি খেলেছেন বন্ডি ক্লাবে।
রিকার্ডি : “কিলিয়ান সবসময় ফুটবল নিয়েই ভাবতো। ফুটবল নিয়েই কথা বলতো। সবসময় ফুটবল খেলা দেখতো। আর তার যখন এসব করার সুযোগ থাকতো না তখন সে প্লেস্টেশনে ফুটবল খেলতো।”
“সে তার শোয়ার ঘরটাকে খেলার মাঠে পরিণত করেছিল। যখন সে ছোট ছিল তখন আমি তাকে অনুশীলন শেষে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। তার মা কাজ থেকে বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত আমি কিলিয়ানকে বাড়িতে দেখাশোনা করতাম।”
“সে সবসময় তার রুমে খেলতে চাইতো। সোফা এমনকি টেবিলেও। সে বলতো তার মাকে যেন এসব না বলি। তার বাবাকেও না। কারণ তারা চায় না সে এখানে খেলুক। ” তিনি বলেন, তারা সেখানে খেলতেন এবং এমবাপের এই ঘরের ভেতরে খেলা তিনি তার পিতামাতার কাছ থেকে গোপন রাখতেন। “কিন্তু সৌভাগ্য যে কখনো সে ঘরে কিছু ভাঙচুর করেনি,” বলেন তিনি।
এরুশ : “সে শুধু ফুটবল নিয়েই ভাবতো আর এটাই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে। অন্যান্য খেলোয়াড়রা যখন কোন ক্লাবের সাথে চুক্তিতে সই করতো, কিম্বা ক্লেয়ারফন্টেইন একাডেমিতে যেত তারা মনে করতো একটা কিছু হয়ে গেছে। কিন্তু কিলিয়ান জানতো কঠোর পরিশ্রম শুরু করার তখনই সময়। যেখানেই পারতো সেখানেই সে খেলতো।”
রিকার্ডি : সে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একজন বড় ভক্ত ছিল। তার শোবার ঘরে চারদিকের দেয়াল রোনালদোর ছবিতে ছেয়ে গিয়েছিল। আরো অনেক বড় বড় খেলোয়াড়েরও ভক্ত ছিল সে। সে কোন একটি বিশেষ দলকে সমর্থন করতো না। তবে সে বহু সেরা ফুটবলারের ভক্ত ছিল। তবে শৈশবে তার নায়ক ছিল রোনালদো।”
“অন্যেরা যখন পার্টি করতে যেত, সে যেত বিছানায়’
এমবাপের বয়স যখন ১৪ তখন তিনি মোনাকোর সাথে চুক্তিতে সই করেন। বলা হয় যে তিনি ফরাসী লীগের ক্লাব ছাড়াও রেয়াল মাদ্রিদ, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল এবং বায়ার্ন মিউনিখে খেলার প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছেন।
মোনাকোর হয়ে তিনি প্রথম ম্যাচ খেলেন ২০১৫ সালের ২রা ডিসেম্বর। বদলি খেলোয়াড় হিসেবে তাকে মাঠে নামানো হয় খেলার শেষ দিকে। মোনাকোতে সবচেয়ে কম বয়সী ফুটবলার হিসেবে রেকর্ড করেন তিনি। এর আগে এই ক্লাবে সবচেয়ে তরুণ ফুটবলার ছিলেন ফরাসী স্ট্রাইকার থিয়েরি অঁরি।
জার্মানিতে ২০১৬ সালে অনূর্ধ ১৯ ইউরোতে একজন তারকা বনে যান এমবাপে। পাঁচটি গোল করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে দুটো গোল ছিল সেমিফাইনালে।
রিকার্ডি : “কিলিয়ান সবসবময় খুব উৎসাহের সাথে খেলতো। যখন কারো তার মতো প্রতিভা থাকবে তখন তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।”
“এএস বন্ডি ক্লাবে তার কোন সমস্যা ছিল না কারণ সে অন্যদের তুলনায় অনেক ভাল খেলতো। কিন্তু মোনাকোতে তার প্রথম বছরটা খুব কঠিন ছিল। কারণ তার কোচ তাকে খুব একটা পছন্দ করতো না। সেই কোচ এখন আর মোনাকোতে নেই। কিন্তু কিলিয়ান এখন প্যারিস সঁ জার্মেইন ও জাতীয় দলে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে ভুলটা ছিল কোচের।”
এরুশ : “আমরা অনূর্ধ ১৯ ফাইনাল দেখতে গিয়েছিলাম, যাতে ফ্রান্স জিতেছিল। তার সাথে স্টেডিয়ামের বাইরে দেখা হয়। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সে অন্যদের সাথে পার্টি করতে গেল না। বরং সে সরাসরি বাড়িতে চলে গেল। সবসময় তার চিন্তা ছিল পরের গোলটা নিয়ে।”
“আমার মনে আছে যেবার মোনাকো চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সে ছিল একমাত্র খেলোয়াড় সেলিব্রেশনের সময় যার হাতে মোবাইল ফোন ছিল না। অন্যরা সবাই পার্টি করতে চলে গেল। কিন্তু সে-ই একমাত্র যে ঘুমানোর জন্যে বাড়িতে গেল। এভাবেই সে অন্যদের চেয়ে আলাদা।”
“অন্যদেরও কিলিয়ানের কাছ থেকে শেখা উচিত। আপনাকে ভাবতে হবে যে আপনি কখনো লক্ষ্যে পৌঁছাননি। প্রতিদিনই আপনাকে কঠোর থেকে কঠোরতর পরিশ্রম করতে হবে।”
‘মনে হয় তার বয়স ৪০’
এমবাপে প্রায়শই সোশাল মিডিয়াতে তার পরিবার নিয়ে পোস্ট দিয়ে থাকেন। সেসব থেকে বোঝা যায় যে তিনি তার পিতা উইলফ্রিডের খুব ঘনিষ্ট। মা ফায়জারও খুব কাছের তিনি। হাই স্কুলে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।
এরুশ : “সে ফুটবল খুব ভালোবাসে। লোকজনকে সম্মান করে। সে তার নিজের শহরকেও খুব ভালোবাসে। এই ক্লাবকে সে ভালোবাসে। এখনও সে এই ক্লাবে তার দিনগুলো নিয়ে কথাবার্তা বলে। যখনই সে সুযোগ পায় তখনই সে এখানকার ক্ষুদে ফুটবলারদের দেখতে চলে আসে। সে খুব সাদামাটা আর সহজ সরল। এজন্যে সবাই তাকে খুব ভালোবাসে।”
“তার বয়স মাত্র ২০; কিন্তু যখন সে কথা বলে তখন মনে হয় যে ৪০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি কথা বলছেন। তার কথায় খুব পরিপক্কতা আছে। কিন্তু যখনই সে এখানে আসে তখন সে শিশু হয়ে যায়।”
রিকার্ডি : “সে আগে যা ছিল এখনও সে তা-ই আছে। সে যখন এখানে আসে সবার সাথে কথা বলে। সব কোচকে সে জড়িয়ে ধরবে, তারপর একটা বল নিয়ে শিশুদের সাথে খেলতে নেমে পড়বে।”
“এখনও আমরা টেক্সট করি, ফোনে কথা বলি। আমি যখন তার বেবিসিটার ছিলাম তখনকার মতোই রয়ে গেছে সম্পর্কটা। সে কখনো বদলাবে না। কারণ সে ভালো শিক্ষা পেয়েছে। তার পেছনে আছেন তার পিতামাতা। তার পরিবারের বন্ধন খুব শক্ত। সে নিজেও পরিবারে বিশ্বাস করে এবং তারা কষ্ট পাবে এরকম কখনো সে কিছু করে না।”
‘প্রতিভা? তার কাছাকাছি কেউ নেই’
রিকার্ডি : “সে যখন ছোট্ট একটা শিশু ছিলো সে বলটা নিয়ে এমনভাবে দৌড়ে যেত সেই একইভাবে সে এখনও খেলে। যেটাকে বলা হয় স্টেপওভার। এটা দিয়েই তাকে আলাদা করে চেনা যেত।”
“আমার ১৫ বছরের কোচিং জীবনে কিলিয়ান সেরা ফুটবলার। তার কাছাকাছি কেউ নেই। প্যারিসে প্রতিভাবান আরো অনেকে আছে কিন্তু তার মতো প্রতিভাবান আর কাউকে দেখিনি।”
এরুশ : “সে যখন ছোট ছিল তখনও তার যে দক্ষতা ও স্বপ্ন ছিল সেটা আর কারো ছিল না। তাকে দেখলেই বুঝবেন সে আর সবার চেয়ে আলাদা। তার মাথার পেছন দিকেও মনে হয় দুটো চোখ আছে। সে বুঝতে পারে বলটা কোথায় গিয়ে পড়বে।”
সূত্র : কিলিয়ান এমবাপে: কীভাবে হয়ে উঠলেন ফরাসী ফুটবলের নতুন সেনসেশন [বিবিসি বাংলা, ১ জুলাই ২০১৮]