আবদুল্লাহ আল মহসিন।।
ধনু নদীর তীরে সিং পদবীধারী সম্ভ্রান্ত লোক বসবাস করত। যাদের অধিকাংশই ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী। পুর শব্দটি ফার্সী। বাংলাদেশে ‘পুর’ ‘পুরী’ বলতে বুঝানো হয় বিরাট প্রাসাদ, দালান কোটা, ইট পাথরে নির্মিত বাসভবন, ইমারত, দূর্গ ইত্যাদিকে। সিং পদবীধারী গোষ্ঠী ও তাদের নির্মিত ইট-পাথরে নির্মিত বাসভবন থেকেই পরবর্তিতে ভাটির এই জনপদটির নাম হয়েছে সিংপুর। কালের প্রবাহে সিং পদবীরা এখন আর কেউ সিংপুরে নেই।
শোনা যায়, তাদের নির্মিত অনেক দালান-কোটা প্রাসাদ নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে সেই সব প্রাচীন নিদর্শনের একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ এখনো দাড়িয়ে আছে সিংপুর গ্রামের তালাবপাড়ে। কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে সেই পুরনো দালান।
স্থানীয় একজন বয়স্ক ব্যক্তির ধারণা মতে, দালানটির বয়স তিন থেকে সাড়ে তিনশত বছর পুরনো হতে পারে। এই দালানে কোন এককালে প্রভাবশালী সনাতন পরিবারের ব্যক্তিরা বাস করতো। ইট সুরকি দিয়ে নির্মিত দালানটিতে এক সময় রামনারায়ণ চৌধুরী পরিবার বাস করতো। আজ তাদের কেউ সিংপুরে নেই। কোথায় আছে তাও জানা যায় না। জমিদারি প্রথা বিলোপ হওয়ার পর প্রভাব কমে যাওয়ায় তারা অন্য কোথাও বসতি গড়তে পারে।
ধ্বংসাবশেষ দালানটি ৮ কক্ষবিশিষ্ট ছিল। ৬টিতে পরিবারসহ থাকতো, ১টি মন্দির ছিল। আরেকটি ছিল অতিথিশালা। হাওরের প্রবল ঢেউয়ে ৩টি কক্ষ ভেঙ্গে গেছে। দালানটি ছোট সাইজের ইট সুরকি দিয়ে নির্মিত। ছাদের উপড়ে বড় ইট দিয়ে ঢালাই করা। ছাদে উঠার জন্য পূর্ব-পশ্চিমে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। গ্রামবাসীর মতে পুরনো দালানটি নির্মানের জন্য ইট তৈরি করা হয়েছে মালিকের তত্ত্বাবধানে সিংপুরেই।
সিংপুর গ্রামের প্রাচীনত্ব ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। বাংলার প্রথম মানচিত্র তৈরি করেন জেমস রেনেল। প্রথম মানচিত্রে নিকলীর যে সমস্ত জনপদের নাম উল্লেখ ছিল এর মাঝে সিংপুরও ছিল একটি। মানচিত্রটি ১৭৬৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় পৌনে ৩শত বছর আগে এই গ্রামের নাম পাওয়া গেলেও বসতি শুরু হয়েছিল আরো বহু আগে। গবেষণায় আরো নতুন অনেক কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে। সিংপুর সম্পর্কে এর আগে যে ইতিহাস বলা হয়েছে এতটা বিস্তৃত আলোচনা আর কেউ করেনি। ইতিহাসচর্চায় নিকলীর পুরনো বিষয় সামনে আসলে আমাদের ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ হবে। ভবিষ্যতে আরো নতুন বিষয় সামনে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। বর্তমানে প্রাচীন এই গ্রামটি বন্যা ও ব্যাপক নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে অনেক ছোট হয়ে গেছে। সরকারিভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে হয়তো নিকলীর মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে প্রাচীন এই গ্রামটি।