হালকা গোলাপি রঙের মাকড়সার জাল। স্বাদে মিষ্টি। নাম হাওয়াই মিঠাই। আসলেও তাই। মুখে মিষ্টি স্বাদের আঁচড় দিয়ে মুহূর্তেই নিঃশেষ। খাওয়ার চেয়ে এর দেখার আকর্ষণই বেশি। অবশ্য সময়ের সঙ্গে এর আকারের পরিবর্তন হয়েছে, শহর এলাকায় যেগুলো বিক্রি হয় তা আকারে বেশ বড়। পলিথিনে মোড়ানো বিশেষ এই মিষ্টির গা। কাঠিতে ধরার ব্যবস্থাও আছে।
মেলা বান্নি তো বটেই, গ্রামের পথে বিশেষ করে ধান কাটার মওসুমে দেখা মিলে হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা দলের। ফেরি করে, টিং টিং ঘণ্টা বাজিয়ে শিশু-কিশোরদের দৃষ্টি কাড়ে তারা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের ঘিরে শিশু কিশোরের দল। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে ব্যস্ত সবাই হাওয়াই মিঠাই বানাতে। সবার হাত চলছে সমানে। অবসর নেই কারও। কেউ ঘোরাচ্ছেন হাওয়াই মেশিনের চাকা, কেউ প্যাকেট করছেন, কেউ মেশিন থেকে নামানো মিঠাইকে গোলাকৃতির রূপ দিচ্ছেন। এরপর পলিথিনে প্যাক করে সাজিয়ে ভরে রাখছেন কাচের বাক্সে। কারিগররা জানান, তৈরি করা হাওয়াই মিঠাই নিয়ে দিনে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের পথে। সন্ধ্যায় ফিরে রাতের খাওয়া-ধাওয়া শেষে আবার বসে পড়েন মিঠাই বানাতে।
হাওয়াই মিঠাই বানাতে খুব বেশি কিছু লাগে না। একটি মেশিন, আর উপকরণ হিসেবে স্পিরিট, চিনি, তেল আর হালকা খাওয়ার রঙ। একটি বাটিতে রাখা ছিল এসব। চলন্ত মেশিনের উপরিভাগের থালার মতো জায়গার মধ্যে ছিদ্রতে দেয়া হয় এই উপকরণ। মেশিনের ঘূর্ণিতে তা রূপ নেয় হাওয়াই মিঠাইয়ে।
১ কেজি চিনি দিয়ে ৫/৬শ’ হাওয়াই মিঠাই বানানো যায়। প্রতি হাওয়াই মিঠাইয়ের দাম ১০ টাকা। ১০০ টাকার উপকরণে হাজার তিনেক টাকার মাল বানানো যায় এমনটাই ধারণা দিলেন এক কারিগর। জানান, নগদ টাকা, চাল, ভাঙারি সামগ্রী দিয়েই এসব বিক্রি করেন। দিনে বিক্রি করে ঘরে ফিরে রাত ৮-৯ টায় বসে পড়েন পরের দিনের মাল বানাতে। ১২টা পর্যন্ত চলে মিঠাই বানানো। সকালে কাঁচের বাক্সভর্তি মিঠাই নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন জায়গায়। কোনদিন বিক্রি করে ৩/৪শ’ টাকা আসে। কোনদিন ২/১শ’। আবার কোনদিন থাকে না। এর কোন গ্যারান্টি নেই।
অনেকে নিজের এলাকায় এসব বিক্রি করতে লজ্জা পান। মোশররফ নামের এক কারিগর জানান, ছোটবেলাতেই আরেকজনের সঙ্গে থেকে এই মিঠাই বানানোর কাজ শিখেছেন। এখন নিজে কারিগর। কিভাবে তৈরি হয় এ প্রশ্নে জানান, চিনি আর চকোলেটের গুঁড়ো মিশিয়ে। পাশেই বাটিতে রাখা চিনি-চকোলেট মিশ্রিত উপকরণ। ক্ষণে ক্ষণে যা মেশিনের মধ্যে ছিদ্রতে ঢেলে দেয়া হচ্ছে। এরপর জাল হয়ে ছড়াতে থাকে চারপাশে।
ইতিহাস
কানাডার প্যাকেনহ্যামে ম্যাপল স্বাদবিশিষ্ট হাওয়াই মিঠাই
চৌদ্দশতকে ইটালিতে চিনি দিয়ে তৈরি এই মজার খাবারটি প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় ঘরোয়াভাবেই সামান্য চিনির ঘন রস বিশেষ পদ্ধতিতে সুতোর মতো তৈরি করে বানানো হত হাওয়াই মিঠাই। আঠারো শতক পর্যন্ত এইভাবে তৈরি হয়েছে। ১৮৯৭ সালে মার্কিন উইলিয়ম মরিসন ও জন সি. ওয়ারটন হাওয়াই মিঠাই তৈরির জন্য প্রথম মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিনের সাহায্যে চিনির যে সুতো তৈরি হতে লাগল সেগুলো আরও সূক্ষ্ম আর বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গেই শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তাড়াতাড়ি খাবারটা তৈরি হয়ে যেতে লাগল। তবে মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই তখন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ব্যাপকভাবে এর প্রসার বাড়ে ১৯০৪ সালে। সে বছর মরিসন এবং ওয়ারটন তাদের মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাজির হলেন সেন্ট লুইসের বিশ্ব মেলায়। অবাক হওয়ার বিষয়, মেলার প্রথম দিনই ২৫ সেন্ট করে ৬৮ হাজার ৬৫৫ বাক্স হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়েছিল, যা ছিল সে সময়ের হিসাবে অনেক বড় একটা অংক! ক্রমেই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় খাবারটি। চাহিদা ও জনপ্রিয়তার জন্য একাধিক কোম্পানি এগিয়ে এল এই মজাদার খাবারটি উৎপাদন ও বিপণনে। টটসি রোল অফ কানাডা লি. বিশ্বের সর্বাধিক হাওয়াই মিঠাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
দেখতে অনেকটা তুলার মতো বলে ১৯২০ সালে মার্কিনরা এই মিঠাইয়ের নাম দিয়েছে ‘কটন ক্যান্ডি’। তারা এই হাওয়াই মিঠাইয়ের এতই ভক্ত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭ ডিসেম্বর দিনটি ‘জাতীয় কটন ক্যান্ডি ডে’ হিসাবে পালন করা হয়।
ইউরোপ-আমেরিকার জয় করে আমাদের এখানে হাওয়াই মিঠাই তৈরি শুরু হয় এমন কথা বলা যায় না। কারণ চিনি দিয়ে তৈরি শোনপাপড়ি বহুকাল আগেই এখানে তৈরি হত। উন্নত বিশ্বের মত আমাদের দেশে অবশ্য আজও সেভাবে হাওয়াই মিঠাই উৎপাদন এবং সুন্দর প্যাকেজিং করে বিপণন হয় না। মেলা, বেড়ানোর জায়গা কিংবা রাস্তার ফেরিওয়ালারাই বিক্রি করে হাওয়াই মিঠাই।