মহসিন মিয়া ।।
সমুদ্র নয়, সমুদ্রের মতোই বিশাল জলরাশি। মাঠ-ঘাট সব পানিতে একাকার। তার ওপর ছোট ছোট দ্বীপের মতো একেকটি গ্রাম। বর্ষা মৌসুমে এমন দৃশ্যপটটির দেখা মিলে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার হাওর জনপদে। বর্ষায় এখানে সামান্য বাতাস এলেই জলরাশি থেকে ভেসে বেড়ায় ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সূর্যাস্তের মূহুর্তটিতে পরিষ্কার আকাশঘেরা সূর্যের আলোয় স্বচ্ছ সমুদ্রসম জলে ধারণ করে সোনালী আভা। রাতের জ্যোৎস্নায় চিক চিক করে বিস্তীর্ণ এ জলরাশি। জৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত এ হাওরাঞ্চলটিকে অনেকটাই সমুদ্রের মতো দেখা যায় বলে এখানে রয়েছে বিচিত্র এক আকর্ষণ। হাওর জনপদের মধ্য ভাগে গড়ে ওঠা খালিয়াজুরী এলাকার এমন মায়াবিনী আর আকর্ষণীয় রূপ দেখে ইতিমধ্যে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। তারা এখানটিকে হোটেল-মোটেলের মাধ্যমে সাজিয়ে পর্যটন কেন্দ্র করতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে।
হাওরদ্বীপ খালিয়াজুরীর প্রতিটি গ্রাম এখন জলবন্দী। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হয় নৌকা কিংবা বাঁশের সাঁকো দিয়ে। তবে বাঁশের সাঁকোর চেয়ে নৌকায় চলাচলের প্রচলনই এখানে বেশি। বর্ষায় যোগাযোগের জন্য নৌকাই ভরসা। এ ক্ষেত্রে মানুষ একসঙ্গে বেশি হলে নৌকার পরিমাণ হতে হয় বড়। অল্প মানুষ চলাচলের জন্য আছে ছোট ছোট নৌকা।
কার্তিকের শেষ দিকে হাওরের পানি সরে যায়। এ সময়টিতে দিগন্তবিস্তৃত মাঠে যতদূর চোখ যায় দেখা মিলে শুধু সবুজ আর সবুজের। মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত হাওরের আঁকাবাঁকা নদ-নদীগুলোতে থাকে বড় বড় রুই, কাতল, চিতল, বোয়ালজাতীয় মাছের সমারোহ। ধান ও মাছের মা হিসেবে পরিচিত এ হাওর জনপদে শীতকালীন সময়টিতে আসে প্রচুর পরিমাণ অতিথি পাখি। বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে থাকা বিল-ঝিলে ভরপুর পাখিদের কলতানে তখন মুখরিত হয় হাওর। তাই ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে খালিয়াজুরীর হাওরে পাখি শিকারে এসেছিলেন ইংরেজ গভর্নর লর্ড কারমাইকেল।
শীত আর বর্ষার আলাদা আলাদা রূপ প্রকৃতিপ্রেমিদের অনন্য আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায় হাওরের মাঠে-ঘাটে-বাঁকে। অবশ্য, ময়মনসিংহ বিভাগের খালিয়াজুরীর এ হাওরপাড়ে বর্ষাকালীন সৌন্দর্য্যটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে অনেকটা বেশি। এ সময়ে এখানে ঘুরতে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। তখন যাতায়াত ব্যবস্থাও থাকে সহজতর। নেত্রকোনা জেলা শহর থেকে মদন কিংবা মোহনগঞ্জ হয়ে সড়কপথে এখানে আসতে সময় লাগে প্রায় ৪ ঘণ্টা।
এদিকে, ঐতিহ্যের দিক থেকেও দেখার মতো স্থান হিসেবে খালিয়াজুরী অনেক সমৃদ্ধ। “নেত্রকোনার ইতিহাস” নামের একটি বইয়ে উল্লেখ আছে, খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দিতে খালিয়াজুরী ছিল কামরূপ রাজ্যের অস্থায়ী রাজধানী। তখন এ রাজ্য শাসন করতেন খত্রীয় জিতারী সন্ন্যাসী নামের এক ব্যক্তি। সে আমলের একটি মঠ এখানে মাথা উঁচু করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। খালিয়াজুরীতে দেখার মতো আরো আছে ময়মনসিংহ গীতিকায় লেখা মহুয়া’র পালার সেই মহুয়া সুন্দরী ও হোমরা বাইদ্যাইর স্মৃতিবিজরিত স্থান মহুয়ারবাগ ও বাইদ্যাইরচর এলাকা। এখানে আছে, শত বছরের পুরনো বৈষ্ণব আখড়া ও মসজিদ, হাসন রাজার নানার বাড়ি, নিখিল ভারত পত্রিকার প্রথম নারী সম্পাদিকা গীতা রানী ও বৃটিশবিরোধী লেখিকা অরুণা দত্তের জন্মভূমি। আরো আছে, ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দের নাজিরুজ্জিয়ল যুদ্ধ স্থল ধনু নদী। নৌবহরের মাধ্যমে এ নদীতেই হয়েছিল ওই যুদ্ধ। নদীটিতে এখনো প্রতিদিন চলে বিশাল আকারের অসংখ্য কার্গো। এখানে সারিবদ্ধভাবে কার্গো চলাচলের দৃশ্য অনেকেরই মন ভুলায়।
খালিয়াজুরী সদরের কলেজ রোড এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পিকনিক স্পট। বর্ষা মৌসুমে সুসজ্জিত নৌকাযোগে প্রতিদিন এখানে আসে একাধিক পিকনিক পার্টি। সিসি ব্লক দিয়ে মোড়ানো ওই রোডের এক পাশে আছে সারি সারি গাছ আর অন্য পাশে বিশাল জলরাশি। রোডের অদূরেও আছে সমুদ্রের মতো পানির প্রভাব। এ পানিতে আছে বালুচর। এলাকাটিতে শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানযোগ্য অত্যাধুনিক ডাকবাংলো আর হাসপাতাল চত্ত্বর জুড়ে থাকা বৃক্ষ কানন।
খালিয়াজুরীর সৌন্দর্য্য আর ঐতিহ্যগুলোকে ভিত্তি করে এখানে গড়ে তোলা যেতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয় উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি তপন বাঙ্গালী জানান, প্রায় ৭ বছরর আগে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তিনি লিখিত আবেদনে জানিয়েছিলেন দেশের পর্যটন কর্পোরেশন যেন এখানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করেন। এখানে প্রায় নিয়মিতই ঘুরতে আসেন দেশী-বিদেশী অসংখ্য পর্যটক। চীনের বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাং-এর মতো পর্যটকও হাওরের জলধারায় পা ভিজিয়েছেন। এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে না উঠায় পর্যটকদের পড়তে হয় থাকা-খাওয়াসহ নানামুখী বিড়ম্বনায়। খালিয়াজুরী সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে বোয়ালী নামক স্থান পর্যন্ত সারা বছর চলাচল উপযোগী একটি সড়কপথ অথবা ফ্লাইওভার নির্মাণসহ উপজেলায় একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। ওই সড়ক আর পর্যটন কেন্দ্রটি হলে পর্যটকদের সুবিধার পাশাপাশি শান্তিপ্রিয় সহজ-সরল ও অবহেলিত মানুষের বসবাস স্থল এ হাওরপাড়ে বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবাহ। সরকার পাবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু জানান, ইতিমধ্যে খালিয়াজুরী মৌজার হেমনগর কান্দার ৩৩৩৩ দাগের ২৬ একর খাস জমি পর্যটন কেন্দ্রের জন্য সনাক্ত করা হয়েছে। ভূমি প্রশাসনের মাধ্যমে খুব দ্রুতই এ জমি প্রতিকি মূল্যে হস্তান্তর করা হবে পর্যটনের নামে।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের পরিকল্পনা বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার খালেদ বিন মজিদ বলেন, এখানে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে। পর্যটনের নামে জায়গা বরাদ্দ হবার কাজটি সম্পন্ন হলেই এ প্রস্তাবটি পাস করতে উঠানো হবে একনেক বৈঠকে।