আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
মানুষের জীবনে অক্সিজেনের পরেই খাদ্য-পানির চাহিদা। আবার খাদ্য গ্রহণ যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি খাদ্য-পরিপাকের পরে বর্জ্য ত্যাগ করাও তেমন জরুরি।
সাধারণত যেসব বদ্ধ জায়গায় গোপনীয়তার সাথে আমরা মানুষেরা আমাদের বর্জ্যবস্তু ত্যাগ করি, তাকেই ইংরেজিতে ‘টয়লেট’ বলি। শুদ্ধ বাংলায় সম্ভবত ‘প্রক্ষালন কক্ষ’ বলা হয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদ সাহেব তার কোনো এক লেখায় ‘হাগন-কুঠি’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন মনে হয়।
নামে কি আসে যায়! টয়লেট বা প্রক্ষালন কক্ষ কিংবা হাগন-কুঠি, যাই বলি না কেন পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জন্যই এ জিনিস প্রয়োজনীয়। সেজন্যই আমরা বাড়িঘর তৈরি করতে গেলে সবার আগে এই বিশেষ কক্ষের নকশা আগে ঠিক করি। কিন্তু আমরা ঘরের বাইরে যখন থাকি, তখন এই বর্জ্যবস্তু ত্যাগ করার প্রয়োজন হলে কি করার? হ্যা! সেজন্যই ‘পাবলিক টয়লেট’। বস্তুত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পাবলিক টয়লেটের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পাবলিক টয়লেটের গুরুত্ব বোঝাতে পুরাতন এক গল্প মনে পড়ল। গল্পটা সম্রাট আকবর আর বীরবল কিংবা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল ভাঁড়- দু’জনকে নিয়েই প্রচলিত। আসল ঘটনা কাদের, তা এখন আর জানা যাবে না। তবে গল্পটা কিন্তু কিংবদন্তী হয়েই আছে। ধরা যাক গল্পটা গোপাল ভাঁড়ের।
একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার দরবারে জিজ্ঞাসা করলেন, “বলতো হে, সবচেয়ে আরামের কাজ কি?”
সবাই বিভিন্ন কথা বললেও গোপাল ভাঁড় বলল, “সম্রাট বা মহারাজ, সবচেয়ে আরামের কাজ হল মলত্যাগ করা।”
মহারাজ তো ক্ষেপে গেলেন, “তবে রে বেয়াদব! দরবারে অশ্লীল কথা। তোর গর্দান যাবে।”
ভাঁড় ভয়ে ভয়ে কিছুদিন সময় চাইল তার কথা প্রমাণ করার জন্য। কিছুদিন পরে বেশ বড়সড় এক খানা-পিনার পরে গোপাল মহারাজকে প্রস্তাব দিলেন নৌকায় বেড়িয়ে আসতে।
বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মহারাজের তলপেট মোচড় দিয়ে উঠল। তার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার দরকার হয়ে পড়ল। নৌকার মাঝিকে তিনি নৌকা পাড়ে ভেড়াতে বললেন। কিন্তু গোপাল মাঝিকে পরামর্শ দিয়ে রেখেছিল একটু দেরি করার।
ইতোমধ্যে মহারাজ অধৈর্য হয়ে উঠলেন এবং বেশ ক’বার তাড়াও দিলেন। অবশেষে নৌকা তীরে ঠেকানোর সাথে সাথেই তিনি লাফ দিয়ে নেমে ঝোপের আড়ালে বসে পড়লেন। সেই যুগে ‘পাবলিক টয়লেট’ বলতে খোলা জায়গা কিংবা ঝোপের আড়ালই বোঝানো হতো। অবশ্য শোনা যায়, এই একবিংশ শতাব্দীতেও নাকি কোনো কোনো দেশের মানুষ খোলা জায়গাতে কাজ সারতেই নাকি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
যাই হোক, মহারাজ মলত্যাগ পর্ব সেরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আহ! পরম শান্তি।”
এবার ভাঁড় বলে উঠল, “মহারাজ, বলেছিলুম না, এটাই সবচেয়ে আরামের কাজ।”
মহারাজ তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং ভাঁড়কে পুরস্কৃত করলেন।
এই প্রবন্ধটিকে যারা অশ্লীল মনে করে আমাকে গালাগালি শুরু করেছিলেন, তারা ইতোমধ্যেই ‘পাবলিক টয়লেট’-এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছেন। আমাদের দেশে পাবলিক টয়লেট নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয় নাই, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রথমত খুঁজে পাওয়া কঠিন। দ্বিতীয়ত, ভয়াবহ রকমের নোংরা!
মহিলাদের জন্য আরও বেশি সমস্যা। কারণ, তাদের জন্য পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা খুবই কম। একবার কোনো এক বাস স্টেশনের পাবলিক টয়লেটে ঢুকে দেয়ালব্যাপী অভিনব ‘কারুকার্য’ দেখে আমার অজ্ঞান হবার অবস্থা। টয়লেটগুলো খুব নোংরা থাকে, সেটা মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু সেখানে ঢুকেই আমার মাথায় যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাওয়া শুরু করল, তা হলো ‘উহারা দেয়ালে এহেন কর্ম কেমনে সাধন করিল!”
“আচ্ছা, চীনাদের পাবলিক টয়লেট কেমন?”
এই প্রশ্ন আমাকে বেশ কয়েকবার শুনতে হয়েছে। কিছুদিন আগে বেইজিং-এ একটা পাবলিক টয়লেট উদ্বোধন করা হয়েছে। এর সম্মুখে বিশাল ফুলের বাগান। পুরো টয়লেটের দেয়াল এবং ছাদ ফুলে ফুলে সাজানো! চীনের সকল শহরেই যেখানে-সেখানে পাবলিক টয়লেট পাওয়া যায়। নদীর ধারে, রাস্তার পাশে, বিপণিবিতানে, উদ্যানের পাশে। এইসব টয়লেটের প্রায় সবগুলোই বিলাসবহুল। পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, আছে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা। বেশিরভাগ জায়গায় টিস্যু পেপার থাকে।
টয়লেটগুলো থাকে ঝকঝকে-চকচকে। কারণ, পরিচ্ছন্নকর্মীরা কিছুক্ষণ পরপরই ঘুরে যায়। অনেক জায়গায় টয়লেটগুলোতে সাউন্ডবক্সে মৃদু শব্দে গান বাজতে থাকে। ভেবে দেখুন, ফুলের গন্ধ, মৃদু আওয়াজে রোমান্টিক গান, নিস্তব্ধ পরিবেশ, চকচকে-ঝকঝকে প্রক্ষালন কক্ষ। এর মাঝে প্রক্ষলন কর্মটি কি রকম আনন্দদায়ক হয়ে দাঁড়ায়!
এখানে বাকি যে ছবি ক’টি শেয়ার করলাম, তা লুঝৌ শহরের নদী তীরের রাস্তার পাশে পাবলিক টয়লেটের ছবি। শহরের বাইরে শহরতলীতে কিংবা গ্রামে এত উন্নত না হলেও পাবলিক টয়লেট পাওয়া দুষ্কর নয় এবং সেগুলোও মোটামুটি পরিষ্কারই থাকে। বলাই বাহুল্য, এসব পাবলিক টয়লেটের প্রায় সবগুলো বিনামূল্যেই ব্যবহার করা যায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। আমার জানা মতে, সকল ধর্মে, সকল সভ্য সমাজে পরিষ্কার-পরিছন্নতার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়, পাবলিক টয়লেটের পরিচ্ছন্নতার দিকে আমাদের আরও বেশি খেয়াল রাখা উচিত।
সূত্র : বিডি নিউজ, ২১ মে ২০১৮