কুরবানী ঈদ : হাটহাজারীতে এখন ব্যস্ত সময় কামারশিল্পীদের

মাহমুদ আল আজাদ, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি ।।

টুং টাং শব্দ দিয়ে দিন শুরু হচ্ছে কামারদের দোকানে। মাসখানেক আগে স্থানটি ছিল নীরব। অথচ এখন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে হয়েছে সরব। কামারের হাতুড়ির টুং টাং শব্দ যেন আর থামছে না। ঈদের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। হাটহাজারীতে কামাররা এখন ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে মুসলমান সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে। ভোর থেকে সেই গভীর রাত পর্যন্ত তারা শুধু একটি কাজ করছে তা হল দা-ছুরিগুলোকে তৈরি ও মেরামত করার কাজ। আর মেরাতের কাজ বেশি হওয়ার কারণে অনেক কামার দোকানে নতুন কাজ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাটহাজারী পৌরসভার অধিকাংশ বাজারে কর্মকারেরা কাজে ব্যস্ত। মুসলমানদের দ্বিতীয় উৎসব ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে হাটহাজারীর কামারদের দোকানে টুং টাং আর শুন শান শব্দে মুখরিত। ঘামছে কামার, পুড়ছে লোহা, তৈরি ধামা, ছুরি, বটি, দা, ব্যস্ততা বাড়ছে প্রতিটি কামার দোকানে। নতুন দা, ছুরি, কিরিস, ধামা, বটি তৈরি করা পুরাতন দা, ছুরিকে শাণ দেয়ায় হরদম কাজ চলছে কামারদের। পুরো বছর তেমন কাজ না থাকলেও কোরবানীর ঈদকে সামনে রেখে তাদের মুখে একটু হাসি ফোটে।

কদর বাড়ে তাদের কুরবানীর ঈদে। কোরবানীর ঈদকে সামনে রেখে কামারশিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করলেও তাদের তৈরি করা সরঞ্জাম বিক্রিতে এখন অনেকটা ভাটা পড়েছে। উচ্চমূল্যে কয়লা, লোহা ও স্টিলের মালামাল কিনে প্রত্যাশা নিয়ে হাটে-বাজারে ক্রেতা না থাকায় ওইসব সরঞ্জাম বিক্রি কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকৃত পুঁজি উঠানো নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এখানকার কামারশিল্পীরা। কামার দোকানে নতুন কাজের জন্য এখন আর সেই আগের মতো নেই মানুষের পদচারণা। জানা যায়, কোরবানীর পশু জবাই ও মাংস কাটতে দা, বটি, ছুরি ও ধামা তৈরিসহ ওইসব পুরানো সরঞ্জাম শান দিতে ইতিমধ্যেই ব্যস্ত সময় পার করছেন এ এলাকার কামারশিল্পীরা।

কামার সম্প্রদায়ের লোকজন লৌহ ও স্টিলসহ বিভিন্ন ধাতবদ্রব্য দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় ওইসব দা, বটি, ছুরি ও ধামা তৈরীর মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের এ পেশা আঁকড়ে ধরে রেখেছে কোনো রকম। ঈদ উপলক্ষে হাটহাজারী মুরগীরহাট বাজার, মিরেরহাট বাজার, চারিয়া বাজার, সরকারহাট বাজার, নজুমিয়াহাট বাজার, বদিউল আলমহাট বাজার, কাটিরহাট বাজার, ইছাপুর বাজার, লোহারপুল, কামতর আলী হাট বাজারসহ আরো একাধিক বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় কামারদের দোকান রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন কামারের দোকানে ঈদকে সামনে রেখে গ্রাহকের আনাগোনা বেড়েছে।

গবাদি পশু জবাই ও মাংস কাটার জন্য দা, বটি, ছুরি ও ধামা তৈরি করতে কয়লার আগুনে লাল করে টকটকে জ্বলে উঠা লোহা-স্টিলের হাতুড়ি দিয়ে দুই দিক থেকে জোরে জোরে পেটাতে হয়। এতে অনেক শক্তির প্রয়োজন পড়ে। পাশাপাশি আঙুল দিয়ে আইতনার রশি টেনে কয়লার আগুনে বাতাস দিতে হয় পাশের আরেকজনকে। কোরবানীকে সামনে রেখে চাহিদা অনুযায়ী কোরবানীর ঈদের জন্য তৈরি দা, বটি, চাপাতি, ছুরি ও ধামাসহ বিভিন্ন সামগ্রী বেচাকেনার জন্য মজুত করলেও অন্য সময় হাটে-বাজারে ক্রেতা নেই বললেই চলে। তাই এ শিল্পে নানা অস্থিরতা ও সংকটের মধ্যে রয়েছে কামারশিল্পীরা। হাটহাজারী বাজারের বিভিন্ন কামারশিল্পীরা জানান, কোরবানীর ঈদ আসলে এ পেশার মানুষদের একটু ব্যস্ততা ও কদর বাড়ে। অন্য সময় অলসভাবে সময় কাটাতে হয়।

এবার ঈদে বটি, দা, ছোট-বড় ছুরি ও ধামা তৈরিতে ৩ থেকে ৪শ’ টাকা করে মজুরি নেয়া হচ্ছে। আর তৈরি করা ওইসব সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৬’শ টাকায়। গরু কাটার ছোট ছুরি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকায়। তবে গরু কাটার ছোট ছুরির চাহিদা একটু বেশি রয়েছে। ওইসব তৈরি করতে যেসব মালামাল প্রয়োজন তা বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়ায় তৈরিকৃত ওইসব মালামাল বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে। আগের মত এখন আর নতুন করে মানুষ ওইসব মালামাল কিনতে চায় না। ঘরে থাকা পুরানো দা, বটি, ছুরি ও ধামা গুলো পুনরায় শান দিয়ে ধারালো করে নিয়ে যাচ্ছে।

আমরা যারা কামার শিল্পে কাজ করি তারা শুধুমাত্র কোরবান ঈদকে সামনে রেখে ক্রেতাদের একটু চোখে পড়ি, আর পুরো বছর জুড়ে আমরা এবং আমাদের এ শিল্প থাকে অবহেলিত। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। যেমন পুঁজি নেই তেমনি আয়ও নেই। সীমিত আয় দিয়ে আমাদের সংসার। আগামীতে এ পেশা টিকিয়ে রাখা খুব কষ্ট হয়ে পড়বে বলেও মত প্রকাশ করেন, তারপরেও পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য কামার শিল্পকে আমরা ধরে রেখেছি বলে জানান কামার শিল্পীরা।

Similar Posts

error: Content is protected !!