মাহমুদ আল আজাদ, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি ।।
হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ত্রিপুরা পল্লীর সোনাই পাড়ায় হাম রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত মঙ্গলবার (২১ আগস্ট ২০১৮) এক পরিবারের দুই শিশুসহ এক সপ্তাহের মধ্যে ৪ শিশুর মৃত্যু এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ৩২ জন হাম রোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তির খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে শনিবার (০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮) পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকতার উননেছা শিউলী, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, আইইসিডিআর প্রতিনিধি দল এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব ইউনুছ গণি চৌধুরীসহ বিভিন্ন সংগঠন ত্রিপুরা পল্লীর সোনাই পাড়া পরিদর্শনে গিয়ে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। তবে এখনও পর্যন্ত আর তেমন কোনো সংগঠনের পা পড়েনি মুনাই পাড়াতে। অবহেলিত রয়ে গেছে ওই মুনাই পাড়া এমনটাই ধারণা সেখানকার বাসিন্দাদের। মুনাই পাড়াতেও বসবাস করে প্রায় ৫৬টি ত্রিপুরা পরিবার।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, সোনাই পাড়া থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার পশ্চিমে মুনাই পাড়ায় যাওয়ার কোনো রাস্তাই নেই। পাহাড় থেকে বেয়ে আসা ছড়া পাড়ি দিয়ে কৃষিজমি ও পাহাড়ের পাশ ধরে পায়ে হেঁটে এ পাড়ায় যেতে হয়। এখানে যোগাযোগের কোনো রাস্তা নেই। মুনাই খালের শাখা ছড়া পারাপারের জন্য নেই কোনো সাঁকো বা কালভার্ট। বর্ষাকালে এ ছড়া পানিতে পূর্ণ হলে ঝুঁকি নিয়ে সাঁতার কেটে পার হতে হয় উত্তর পাড়ে বসবাস করা অন্তত ২৫টি পরিবারের সদস্যদের। এ পাড়ার কোমলমতি ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত শিক্ষার আলো থেকে। এখানে নেই কোনো সুপেয় পানির ব্যবস্থা, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ, নেই স্বাস্থ্য সেবা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ ত্রিপুরারা পার্শ্ববর্তী পাহাড় থেকে কাঠ সংগ্রহ করে সে কাঠ কাঁধে নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করে এবং জুম চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্তমানে সে সুযোগটাও একেবারে কমে গেছে। কারণ হিসাবে মুনাই পাড়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ত্রিপুরা যুবক জানান, প্রভাবশালীরা এখন প্রায় পাহাড় সরকার থেকে লিজ নিয়ে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা লাগিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে এখন আমরা আগের মতো জুম চাষ করতে পারি না। আর এ কারণে আমাদের অভাব অনটনও এখন অনেক বেড়ে গেছে। হিমশিম খেতে হচ্ছে সংসারের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে। মুনাই ছড়ার উত্তর পাশের টিলায় বসবাস করা প্রায় ২৫টি পরিবারের সবাই খোলা স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করে বলেও জানা যায়। আবার সেগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে খালে বিলে ও পার্শ্ববর্তী ছড়ার পানিতে পড়ে। আর এ পানি পান করে প্রতিনিয়ত তারা শিকার হচ্ছেন পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন প্রকার রোগের।
বর্ষার দিনে মুনাই ছড়াতে পানি পূর্ণ থাকায় ছড়া পাড়ি দিয়ে এ পাড়ার মূল রাস্তায় আসাটাও অসম্ভব হয়ে পড়ে ওই ২৫টি পরিবারের সদস্যদের। এ মুনাই পাড়াতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। এখানকার প্রায় সবাই রান্নার কাজে ও খাবার পানি হিসাবে পান করে পাহাড় থেকে শুরু হয়ে মুনাই খালের সাথে মিশে যাওয়া মুনাই শাখা ছড়ার পানি। একটি টিউবওয়েল এ পাড়াতে থাকলেও সেটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে প্রায় বছরেরও অধিক সময় ধরে। নষ্ট এ টিউবওয়েল স্থানীয়রা কোনো মতে ফোটা ফোটা পানি পড়ার ব্যবস্থা করেছে। তবে তাতে একটা কলসি পূর্ণ হতে প্রায় আধ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। যার কারণে তাদের বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে সাংসারিক কাজ কর্মসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে হচ্ছে মুনাই ছড়ার পানি দিয়ে। এ পল্লীর মুনাই পাড়ার গৃহিনী চম্পা ত্রিপুরা জানান, পানির কলটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। যদি সরকারের পক্ষ থেকে এ নষ্ট পানির কলটা মেরামত করে দেয়া হতো তবে মুনাই পাড়ার জনগণ কোনো মতে বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনটা অন্তত মেটাতে পারতো।
সোনাই পাড়ার ৫২টি পরিবারের প্রায় অর্ধেক পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ গেলেও মুনাই পাড়ার ধারে কাছেও যায়নি বিদ্যুৎ সুবিধা। ফলে সন্ধ্যা হলেই এ পাড়ায় নেমে আসে গভীর অন্ধকার। কেরোসিন কেনার সামর্থ্য না থাকায় এখানকার প্রায় পরিবার সূর্য ডুবার সাথে সাথে রাতের খাবার শেষ করে অন্ধকার নেমে আসা মাত্রই সুন্দর সকাল দেখার প্রত্যাশায় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যান। গত দুই-তিন মাস আগে বিদেশী সংস্থার দু’জন মহিলা কর্মী মুনাই পাড়া পরিদর্শন করে একমাত্র ধর্মীয় উপাসনালয়ে ১টি, চলাচলের কাদা মাখা পথে ৪টি, ৫৬টি পরিবারের মধ্যে ১৫টি পরিবারের প্রতি পরিবার বা ঘরে একটি করে মোট পনেরটি সোলার লাইট দিয়ে অন্ধকার এ পাড়ার কিছু অংশকে আলোকিত করেছিলেন। দুঃখের বিষয় ২ মাস যেতে না যেতেই বর্তমানে পনেরটি ঘরের সবগুলো সোলার লাইট নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। আর রাস্তার ৪টি লাইটের মধ্যে দু’টি লাইট একটু একটু জ্বললেও বাকি দু’টির যায় যায় অবস্থা।
অপর দিকে নিজেদের উদ্যোগে মাটি দিয়ে তৈরি মুনাই পাড়ার একমাত্র ধর্মীয় উপাসনালয়টিও (মন্দির) জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। এ মন্দিরটির নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো বেষ্টনী, মন্দিরের কাঠের তৈরি দু’টি জানালাও ভাঙ্গা, চারপাশ ঝোপ জঙ্গলে ভরা। প্রার্থনা করার জন্য মন্দিরে আসা-যাওয়ার কোনো রাস্তাও নেই। মুনাই ছড়ার পানি পথ পাড়ি দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় একমাত্র এ উপাসনালয়টিতে। সুকুমার ত্রিপুরা বলেন, মুনাই ছড়ার এপার থেকে ওপারে চলাচলের জন্য একটা সাঁকো বা কালভার্টের ব্যবস্থা করলে উত্তর পাড়ে বাস করা জনগণের জীবনযাপন যেমন সহজ হবে তেমনি প্রার্থনার জন্য মন্দিরে আসা-যাওয়া করাতেও আর কোনো বাঁধা থাকবে না।
ত্রিপুরা পল্লীর মুনাই পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, চারজন শিশুর প্রাণের বিনিময়ে এ পল্লীতে মানুষের নজর পড়েছে। তবে সবাই সোনাই পাড়া নিয়ে ব্যস্ত, পরিদর্শন, ত্রাণ বিতরণ সব হচ্ছে সোনাই পাড়াতে, আমাদের মুনাই পাড়াতে তেমন কেউ আসেইনি। তবে ইউনুচ গনি চৌধুরী এসে কিছু ত্রাণ দিয়েছিলেন। আর কোনো নেতা বা সংগঠন এখানে কিছু দেয়নি। শুধুমাত্র ভোটের সময় প্রার্থীরা এলাকায় আসে। ভোট শেষ হলে কেউ তাদের খবর রাখে না। অনেক পরিবারের সন্তানদের জন্মনিবন্ধনও নেই। এ ত্রিপুরা পল্লী দুর্গম এলাকায় হওয়াতে এ পল্লীর জনগণ নানা ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের দেখার মতো কেউ নেই বললেই চলে। তারা এ দুর্গম ত্রিপুরা পল্লীর দুই পাড়ায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবাসহ সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেয়ার জোর দাবি জানান।
এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, এরকম একটা জনগোষ্ঠী ওই এলাকায় আছে তা সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান কখনো আমাদের জানায়ওনি। সোনাই পাড়ার কাজ শেষ হলে মুনাই পাড়ায় এক মাসের মধ্যে প্রতিটা ঘরে বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন, ২টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে সুপেয় পানি, যাতায়াতের জন্য রাস্তারও ব্যবস্থা করা হবে।