বিশেষ প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ ।।
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় দুই বছর পর পাঁচজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করল পুলিশ। দীর্ঘ প্রায় ২৫ মাসের তদন্ত শেষে গতকাল বুধবার (১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮) কিশোরগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট মো: হাবিবুল্লাহর আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করা হয়। রক্তাক্ত এই হামলায় ২৪ জন জড়িত ছিল বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেছে তদন্ত কর্মকর্তা। এদের মধ্যে জীবিত পাঁচজনকে আসামি করা হয়। বাকি ১৯ জন ঘটনার দিনসহ বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদেরকে মামলার অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার প্রার্থনা করা হয় আদালতের কাছে। অভিযুক্ত পাঁচজনের সবাই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে বলে জানানো হয়।
মামলার জীবিত পাঁচ আসামি হলেন, কিশোরগঞ্জের পশ্চিম তারাপাশার মো: আবদুস সাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক ওরফে তানিম (২৪), গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার রাঘবপুর গ্রামের ওসমান গণি মণ্ডলের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজিব গান্ধি ওরফে সুভাষ ওরফে জাহিদ (৩২), চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার হাজারদিঘা চাঁদপুর গ্রামের মৃত হোসেন আলীর ছেলে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান (৬০), গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার পান্থাপাড়া গ্রামের মৃত হাকিম উদ্দিন আকন্দ’র ছেলে মো: আনোয়ার হোসেন ও কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি থানার সাদিরপুর কাবলিপাড়া গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে মো: আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে জয় ওরফে মুসাফির ওরফে নুরুল্লাহ (৩৩)।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো: মাশরুকুর রহমান খালেদ গতকাল বিকেলে তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে চার্জশিটের বরাতে এসব তথ্য দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা এই হামলা চালিয়েছিল। এই হামলার ব্যাপারে জঙ্গিদের প্রথম বৈঠক হয় ঘটনার এক বছর আগে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার কাছে মামলার আসামি জঙ্গি মাহফুজুর রহমান ওরফে সুজনের ভাড়া বাসায়। সশস্ত্র হামলার ব্যাপারে মূল পরিকল্পনা হয় ঘটনার ১৩ দিন আগে ঢাকার বসুন্ধরার অ্যাপোলো হাসপাতালের পিছনে মামলার আসামি জঙ্গি তানভীর কাদেরির বাসায়। পরবর্তীতে ঘটনার দুই দিন আগে মিরপুরের শেওরাপাড়ার একটি বাসায় জঙ্গি নুরুল ইসলাম মারজান, সারোয়ার জাহান ওরফে আবদুর রহমান ও রাজিব গান্ধি মিলে শোলাকিয়া হামলার বিষয়ে চূড়ান্ত একটি পরিকল্পনা মিটিং করে। ওই মিটিংয়ে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ইমাম ফরীদ উদদীন মাসউদকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়।
চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, ভারত থেকে আমের চালানের সাথে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয় শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার জন্য। শোলাকিয়া হামলার খরচের যাবতীয় টাকা সিরিয়া, সৌদি আরব ও পাকিস্তান থেকে চকলেট হুন্ডির মাধ্যমে আনা হয় বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।
এ মামলায় সব মিলে মোট সাক্ষীর সংখ্যা ১০২ জন। এর মধ্যে ৭৩ জন ঘটনা সম্পর্কে জানেন কিংবা ঘটনা দেখেছেন এমন জবানবন্দী দিয়েছেন। ঘটনার সময়কার আলামত আদালতে পাঠানো হয়েছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শোলাকিয়া ঘটনার আগে জঙ্গিরা এলাকাটি আগে রেকি করে। দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতে হামলা চালালে সারা বিশ্বে আলোড়ন হবে এমনটি ধারণা ছিল জঙ্গিদের। তারা মনে করেছিল ঈদের দিন হাজার হাজার মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃংখলা বাহিনী এই হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হবে।
এ মামলার তদন্তে এতদিন লাগল কেন? এমন এক প্রশ্নে তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এ ঘটনায় সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। জীবিত একজন পরে র্যারের ক্রসফায়ারে মারা যায়। ফলে আলামত পরীক্ষা ও প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করতে সময় লেগে যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে অভিযানকালেও বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে; যাদের জীবিত ধরতে পারলে আরও বেশকিছু তথ্য পাওয়া যেত। আরো দ্রুত তদন্ত শেষ হতো। এ ছাড়া তদন্ত যাতে নির্ভুল হয়, এ কারণে কিছু সময় লেগেছে।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদের দিন সকালে শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে ২ পুলিশকে হত্যা করে উগ্রবাদীরা। এ সময় উগ্রবাদীদের সাথে পুলিশের গোলাগুলির সময় এলাকার এক গৃহবধূ মারা যান।
এ ঘটনায় তল্লাশি চৌকির দায়িত্বে থাকা পাকুন্দিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সামসুদ্দীন ১০ জুলাই ২০১৬ তারিখে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করেন। মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন ওই সময়ে কিশোরগঞ্জ সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান। পরে এই মামলার তদন্ত শেষ করেন বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক মো: আরিফুর রহমান। তিনিই গতকাল মামলার চার্জশিট দাখিল করেন।