সদালাপী মানুষকে আল্লাহ পছন্দ করেন

মৃধা মো: রেজাউল করিম

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সরল-সঠিক কথা বলো। তাহলে তিনি তোমাদের কার্যাবলিকে (আ’মাল) সংশোধন করে দেবেন এবং তোমাদের যাবতীয় গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন; আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর আনুগত্য করবে, সে বিরাট সফলতা অর্জন করবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৭০-৭১)। এ দিকে রাসূলে আকরাম সা: ইরশাদ করেছেন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সা: ইরশাদ করেছেন- ‘প্রকৃত মুসলমান তো সে যার মুখ ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকে এবং প্রকৃত মুহাজির (ত্যাগকারী) তো সে যে আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা ত্যাগ বা বর্জন করে।’ ইমাম বুখারি রহ: উল্লেখ করেছেন এবং মুসলিম শরিফের বর্ণনায় আছে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা: বলেন- ‘নিশ্চয়ই এক ব্যক্তি নবী করিম সা:’কে জিজ্ঞাসা করল, কোন মুসলমান উত্তম? তিনি বললেন যার মুখ ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপত্তা লাভ করে।’
উপরিউক্ত কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, ইসলামে সদালাপের বা সৎসংলাপের কতই না গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের অনেক সময়ই চলমান সমস্যা নিরসনকল্পে প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপে বসতে হয়। মূলত সংলাপের আগে এর পরিবেশ তৈরি করতে হয়। অন্যথায় তা অবজ্ঞা-অবহেলা আর অহঙ্কারিত্বসহ নানা কারণে স্রোতে ভেসে যায়। পরিবেশ তৈরি করা বলতে পরস্পরের প্রতি সদাচার, মার্জিত ব্যবহার ও হিংসাত্মক বাক্য ছোড়া থেকে বিরত থাকাকে বোঝানো হচ্ছে। মুখ থেকে এমন কোনো পীড়াদায়ক কথা যেন বের না হয়, যাতে মানুষ কষ্ট পায় এবং সম্ভাব্য সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। আর এমনটি হলে তাও সদালাপের খেলাফ বা বিরোধী, যা মোটেই কাম্য নয়। কেননা দল-মত নির্বিশেষে সব ধর্মমতের ঐকমত্যে এটা সত্য-স্বীকৃত যে, হানাহানি-খুনোখুনি নয়, সদালাপ বা সৎসংলাপই বিদ্যমান সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র উপায়। যেখানে ব্যক্তি-পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মুক্তি-শান্তির ন্যায্য অধিকার নিহিত। এ বিষয়টিই কুরআন ও হাদিসের পূর্বোক্ত উক্তিতে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বলা হয়েছে, তোমরা সরল-সঠিক কথা বলো এবং তোমাদের মুখ ও হাত থেকে যেন অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। অর্থাৎ সংলাপটা মূলত মুখের সাথে সম্পর্কিত। সদা আত্মসচেতন থাকতে হবে যাতে অন্তত আমার কথাবার্তা ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অন্য কেউ বিষাদগ্রস্ত না হয়। এ বিষয়কেই কাব্যিক ধারায় ব্যক্ত করতে পারি-
‘সদালাপ, সদাচার, সৎসংলাপ
মানবতার কল্যাণে মহান ধাপ
গণচিত্তে নির্মূল বিষাদের ছাপ
টেকসই শান্তি বিদূরিত অভিশাপ’
আমরা অনেক সময় নানা আলাপচারিতা, বক্তৃতা ও সভা-সেমিনারে আয়োজিত ভাষণে এমন সব বচন প্রয়োগ করি যা বন্ধুমহল, প্রতিবেশী, প্রতিপক্ষ, সর্বোপরি আমজনতার হৃদয়ে তীব্র ব্যথা সঞ্চার করে, যা কুরআনে চাক্ষুষভাবে নিষিদ্ধই দৃশ্যমান হয়। মহান আল্লাহ বলেন- ‘প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ বা ধ্বংস’ (সূরা আল হুমাযাহ : ১)। তা ছাড়া আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের এক সম্প্রদায় (কেউ) যেন অন্য সম্প্রদায়কে (কাউকে) উপহাস না করে, কেননা তারা (উপহাসকৃত) উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে, এবং কোনো নারী যেন অপর নারীকে উপহাস না করে, কেননা তারা (উপহাসকৃত) উপহাসকারিণীগণ অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং তোমরা পরস্পরকে দোষারোপ কোরো না ও মন্দ নামে ডেকো না; বিশ্বাস (ঈমান) স্থাপন করার পর কতক মন্দ নামে ডাকা পাপাচার, আর যে (এর পরও) ক্ষমাপ্রার্থনা (তওবা) না করে, অতএব, তারাই অত্যাচারী (জালেম)’ (সূরা আল-হুজরাত :১১)।
আলাপ-আলোচনা বলতে এখন আর চার দেয়ালের মধ্যে এক টেবিলে বসাকেই শুধু বোঝায় না; বরং প্রযুক্তির এ আধুনিকতার যুগে মিডিয়ার বৈপ্লবিকতায় মুহূর্তেই মুখনিঃসৃত ধ্বনি ও কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। গণমানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হোক এ রকম কোনো পদক্ষেপই ইসলামে স্বীকৃত নয়। যেখানে হাদিসে সৃষ্টিকুলকে কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে বিরত রাখার জন্য পথের কষ্টদায়ক বস্তুটি পর্যন্ত সরিয়ে ফেলার ইঙ্গিত করা হয়েছে, সেখান আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে পারস্পরিক কথাবার্তা, বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে আঘাত প্রদানের তো প্রশ্নই ওঠে না। হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সা: ইরশাদ করেছেন- ‘বিশ্বাসের (ঈমান) সত্তর অথবা ষাটের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে, তন্মধ্যে সর্বোত্তম হলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- এই বাক্য (কালিমা) বলা এবং সর্বনিম্ন হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা আর লজ্জাশীলতা বিশ্বাসের (ঈমানের) একটি শাখা’ (মুসলিম, মূলকিতাব ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৭)।
সুতরাং আমাদেরকে মানুষসহ যাবতীয় সৃষ্টিকুলকে কষ্টদান থেকে বিরত থেকে সদালাপ-সদাচার, সৎসংলাপের মাধ্যমে সহিংসতা পরিহার করে ভাইয়ে ভাইয়ে মিলেমিশে থাকতে হবে। তবেই একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে আমরা সক্ষম হবো। আর সর্বদা আমাদেরকে কুরআনের এই উদ্ধৃতি মনে রাখতে হবে- ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই, অতএব তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে (সমস্যা) সংশোধন করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা (আল্লাহর) অনুগ্রহ প্রাপ্ত হতে পারো’ (সূরা আল-হুজুরাত :১০)।
লেখক : প্রবন্ধকার

সূত্র : নয়া দিগন্ত

Similar Posts

error: Content is protected !!