নিকলীকে মডেল উপজেলা হিসেবে গড়ে তুলতে চাই

অফিসে কর্মব্যস্ত
অফিসে কর্মব্যস্ত

সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে নিকলীর প্রথম অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আমাদের নিকলী.কম-এর নতুন উদ্যোগ- সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে স্থানীয় বিশেষ ব্যক্তিত্বের চিন্তা-ভাবনা এ প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয়া। সেই আলোকে সম্প্রতি নিকলী উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব কারার সাইফুল ইসলামের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন নিকলী সম্পর্কে তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সম্মানিত পাঠকদের জানার স্বার্থে দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশ হলো প্রথম পর্ব

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : তোফায়েল আহছানআবদুল্লাহ আল মহসিন

নিকলীর একমাত্র অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আমাদের নিকলী ডটকম সম্পর্কে কিছু বলুন।
কারার সাইফুল ইসলাম : আমাদের নিকলী ডটকম সম্পর্কে আমি অবহিত। এ ধরনের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। সাধুবাদ জানাই। আমি যখন কলেজে পড়ি, বিমানকেন্দ্রিক একটি স্লোগান ছিল। রাজধানীর ফার্মগেটে ওভারব্রিজে লেখা ছিল “The World is becoming smaller to us”।
পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। ইন্টারনেট, মোবাইল, ফেসবুকের সুবাদে সারা পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। বর্তমান সরকারের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগে দূরত্ব এখন কমে এসেছে। প্রতি মুহূর্তে সারা পৃথিবীর সব খবর আমরা জানতে পারি। নিকলী যোগাযোগের দিক থেকে একসময় পশ্চাৎপদ এলাকা ছিল। তখনও নিকলীতে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন শিশু-কিশোর সংগঠনের উদ্যোগে নানান প্রকাশনা ছিল। উল্লেখযোগ্য দুটি সংগঠন ছিল খেলাঘর আসর ও চাঁদের হাট। এদের মধ্যে তুলনামূলক ভালো করার একটা তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল। বর্তমান প্রজন্ম নেশাগ্রস্ত হয়ে এ চর্চা থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। আশির দশকে আমরা খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃত্বে ছিলাম। তখন জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত পুরস্কার ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এখন সাঁতারে শুধু আছে। সব ধরনের মিডিয়ায় নিকলী অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের নিকলী ডটকম নামে যে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম চালু হয়েছে, এর ফলে এ পিছিয়ে থাকা অনেকটা ঘুচাতে সক্ষম হবে। আপনারা এগিয়ে আসলে এমন কার্যক্রমে আমার সহযোগিতা সবসময় থাকবে।

জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছেন

শিক্ষার আধুনিকায়নে আপনার উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন।
কারার সাইফুল ইসলাম : ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ লক্ষ্যে পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। এবং এর রেজাল্ট পেতে শুরু করেছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটালাইজ করার জন্য সংসদ সদস্য আলহাজ আফজাল হোসেন খুবই আন্তরিক। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে, সবকটিতেই কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছি। শিক্ষার্থীরা বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মাননীয় সংসদ সদস্য এবং আমি নির্বাচিত হওয়ার পর যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল-ভালো রেজাল্ট করলে সংবর্ধনা, আর্থিক সহায়তা ও উদ্দীপনা পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। জেলার কোথাও না হলেও আমি সেটা করেছি। ৫৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৫টি মাদ্রাসা, ১টি কলেজ আছে। আমি প্রত্যেকটি ভিজিট করেছি। কলেজের আর্থিক দৈন্যদশা দূরীকরণে কাজ করেছি। উপজেলার একমাত্র কলেজটি ডিগ্রিতে উন্নীত করার জন্য প্রিন্সিপাল আবেদন করেছেন; আমি ও মাননীয় সংসদ সদস্য চেষ্টা চালিয়ে সফল হয়েছি। এখন ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষ চলছে। ডিগ্রি চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বিশেষ করে মেয়েরা ঝরে পড়ে। ডিগ্রিতে উন্নীত হওয়ার ফলে নিকলীতে উচ্চশিক্ষার হার অনেক বাড়বে, আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সুবিধা হবে। অদূর ভবিষ্যতে অনার্স চালুর চেষ্টা চলছে। তাছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো তালিকা করে এগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতেও এ ধারা চলমান থাকবে।
ছাত্রকালীন ‘রাস্তার ছেলে’ নামে একটি নাটক অনেকবার মঞ্চস্থ করেছেন; যার মূল ভূমিকায় ছিলেন আপনি। একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ হওয়ার পরও নিকলীর সংস্কৃতি অঙ্গন পিছিয়ে কেন?
কারার সাইফুল ইসলাম : শুধু রাস্তার ছেলেই নয়, অনেক নাটকই আমি করেছি। পারফর্ম যেমন করেছি পৃষ্ঠপোষকতাও করেছি। এখন নিবেদিতপ্রাণ উদ্যোক্তা ও পারফরমার আসছে না। অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলেও দর্শকদের মাঝে আগ্রহ কমে গেছে। এজন্য উদ্যোক্তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। একসময় জারি গান, সারি গান, ঘাটু গানের প্রচলন ছিল। একটি গান আছে ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আঞ্চলিক সংস্কৃতি অঙ্গন প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছে। আমাদের সময় নিকলীতে টেলিভিশন তেমন একটা ছিল না। সংস্কৃতিকে লালন করার মানসিকতা এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাঝে নেই। অনেকে নেশায় আসক্ত হয়ে কোন পথে ধাবিত হচ্ছে নিজেরাও জানে না। নতুন করে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি শিল্পকলা একাডেমীকে সচল করার। স্থানীয় অডিটরিয়ামটি নতুন করে নির্মাণ করছি। এ অঙ্গনে প্রণোদনা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। আশা করি আবার সুদিন ফিরবে।

স্পিডবোটে করে নৌকাবাইচ পরিদর্শন করছেন

নিকলীর খেলাধুলায় বিরাট ঐতিহ্য ছিল। বিভিন্ন খেলায় ধারাবাহিকভাবে ভালোমানের খেলোয়াড় পেতাম। আপনি এক সময়ের একজন কৃতী খেলোয়াড় হিসেবে বলবেন এখন কেন ভালোমানের খেলোয়াড় পাচ্ছি না?
কারার সাইফুল ইসলাম : এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাঝে নিজেদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। সেই সাথে পৃষ্ঠপোষকতারও অভাব আছে। আমাদের সময় যে কোনো ইভেন্টে সারাবছর প্র্যাকটিস করতাম। এখন যারা আসছে সবাই সিজনাল খেলোয়াড়। বেশিরভাগ নেশাগ্রস্ত। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের ফলে এ অঞ্চলে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ অনেক কমে গেছে। ফুটবলে জাগরণের জন্য প্রতিবছর উপজেলা পরিষদের ব্যানারে উপজেলা চেয়ারম্যান গোল্ডকাপ চালু করেছি। এই খেলা দেখার জন্য এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়।
নিকলীর শত বছরের ঐতিহ্য নৌকাবাইচ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার চালু করা হয়। তৎকালীন এলজিইডি মন্ত্রী জিল্লুর রহমান সাহেব প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। সাবেক সচিব কারার মাহমুদুল হাসান সাহেব আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। ক্ষমতা পালাবদলের সাথে সাথে আবারো বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবার যখন ক্ষমতায় আসি নিকলী-বাজিতপুরের মাননীয় সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতায় পুনরায় চালু করা হয় ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। এখন পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।
আমরা দেখেছি, এক সময় ভাদ্র মাসের ১ তারিখ আসলে এমনিতেই নৌকাবাইচ আয়োজন হতো। কারো ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল না। তখন স্ব-স্ব উদ্যোগে ব্যক্তির নামে নৌকা ছিল। এখন পাড়াভিত্তিক চাঁদা তুলে নৌকা নির্মাণ করা হয়। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, নিকলীর ইতিহাস-ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার।

কৃতী সাঁতারুদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে

সাঁতারে নিকলীর ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। এ সম্পর্কে আপনার পরিকল্পনা জানাবেন।
কারার সাইফুল ইসলাম : নিকলীতে সাঁতার শিখে নামী-দামী প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে উন্নতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশসেরা হচ্ছেন। এই সুবাদে এলাকার অনেক ছেলেমেয়ের ভালো চাকরির সুযোগও হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে নিকলী সুইমিং ক্লাব ও ভাটিবাংলা সুইমিং ক্লাব নামে দুইটি ক্লাব নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করছি। উপজেলা পরিষদের পুকুরে ২টি টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে দিয়েছি। এর ফলে ডাইভ ও টার্নিংয়ের প্রশিক্ষণ সহজ হয়েছে।
কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় নিউজ করেছে ‘নিকলী মানেই সাঁতার‘ শিরোনামে। সাবেক সচিব কারার মাহমুদুল হাসান সাহেব এটি দেখার পর আমাকে ফোন দিয়ে কথা বলেন। এরপর তিনি বর্তমান ক্রীড়া সচিব নূর মোহাম্মদ সাহেবের সাথে কথা বললে নিকলীতে একটি সুইমিং পুল নির্মাণে আশ্বাস দেন। এ বিষয়ে মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ আফজাল হোসেনকে অবহিত করা হয়। একটি ভালোমানের সুইমিং পুল তৈরির উদ্দেশ্যে নিকলী সদরের দোয়ারহাটির ভেতরের পুকুরটির (আড়া নামে পরিচিত) সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। এটিকে সুইমিং পুল করা হলে একই সাথে আশপাশের পরিবেশও সুন্দর হবে। জাতীয় পর্যায়ের বেশিরভাগ সাঁতারু নিকলীর; ফলে ক্রীড়া সচিব মহোদয়ও বেশ আন্তরিক সুইমিং পুল করার ব্যাপারে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া বয়সভিত্তিক সাঁতারে যারা ভালো করেছে, সবাইকে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনার মাধ্যমে উৎসাহিত করেছি। ভবিষ্যতে প্রণোদনামূলক আরো কার্যক্রম চলমান থাকবে।
নিকলীকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে কি ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
কারার সাইফুল ইসলাম : এখান থেকে ভোরের সূর্যোদয় পরিপূর্ণভাবে দেখা যায়। রাতের ভ্রমণে জ্যোৎস্না স্নান বেশ উপভোগ্য বিষয়। এখনো জানাশোনা অনেকেই নিজেদের উদ্যোগে আসছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রতিবছর বর্ষাকালে এই সৌন্দর্য উপভোগের জন্য নিকলীতে আসেন।
কিশোরগঞ্জের ডিসি সাহেব অফিসিয়াল ট্যুরে প্রথমবার এসে হাওরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কিছুদিন পরই পারিবারিক ট্যুর করতে নিকলী চলে আসেন।

পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার আমরা চেষ্টা করছি তৈরির জন্য। সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে লেখালেখি করেছি। প্রশাসনিক সভা-সেমিনারে আলোচনা করেছি। বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের সাথেও আলোচনা হয়েছে। আশা করি সবার প্রচেষ্টায় সফল হবো।

 

সাক্ষাতকারের দ্বিতীয় পর্ব দেখতে ক্লিক করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!