সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে নিকলীর প্রথম অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আমাদের নিকলী.কম-এর নতুন উদ্যোগ- সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে স্থানীয় বিশেষ ব্যক্তিত্বের চিন্তা-ভাবনা এ প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয়া। সেই আলোকে সম্প্রতি নিকলী উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব কারার সাইফুল ইসলামের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন নিকলী সম্পর্কে তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সম্মানিত পাঠকদের জানার স্বার্থে দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশ হলো দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : তোফায়েল আহছান ও আবদুল্লাহ আল মহসিন
দেশের প্রায় সব উপজেলাতেই ভিন্নমতের লোকজন মামলায় তটস্থ আছেন। নিকলীতে সহাবস্থান লক্ষণীয়। কিভাবে মেইনটেইন করছেন?
কারার সাইফুল ইসলাম : নিকলীতে আবহমান কাল থেকেই সহাবস্থানের কালচার বিদ্যমান। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা চেষ্টা করছি কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে। নিকলীতে তেমন কোনো জ্বালাও-পোড়াও নাই; ঘুম থেকে উঠলে যাদের সাথে দেখা হয়, কথা হয় এদের সাথে সমস্যা বাড়িয়ে কি হবে? এখানে স্থানীয়ভাবে কালচারাল প্রোগ্রাম, খেলাধুলা সব একসাথেই করি। থানা থেকে কোনো তথ্য পেলে চেষ্টা করি যেন হয়রানি না করা হয়। পার্শ্ববর্তী উপজেলা বাজিতপুরের সাথেই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনেক পার্থক্য। এসব সম্ভব হচ্ছে স্থানীয় নেতৃত্বে পজিটিভ চিন্তাভাবনা লালন করার ফলেই।
নিকলীকে মাদকমুক্ত করতে আপনার পরিকল্পনা কি?
কারার সাইফুল ইসলাম : আমি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির উপদেষ্টা। মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী কারা আমরা সবাই কিন্তু কম-বেশি জানি। শুধু আইন প্রয়োগ করে সাময়িক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, নির্মূল নয়। চেষ্টা চালাচ্ছি কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সঠিক পথে ফেরানোর। ইউনিয়নভিত্তিক আইন-শৃঙ্খলার সভা করবো। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদেরকে জানানো হয়েছে। একই সাথে আমরা মাদকে আসক্ত এবং তাদের অভিভাবকদের আমন্ত্রণ জানাবো; মাদকসেবী হিসেবে নয়, এলাকার সাধারণ জনগণ হিসেবে। আলোচনায় বোঝানো হবে পাশাপাশি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হবে, পরবর্তীতে আমরা কঠোর হতে বাধ্য হবো। আমি বিশ্বাস করি এরকম উদ্যোগে সবার মাঝে একটা ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
হাওরাঞ্চলে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রজনন এবং মৎসজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে গবেষণামূলক কোনো উদ্যোগ আছে কি?
কারার সাইফুল ইসলাম : মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, নতুন নতুন জাল ব্যবহার করা হচ্ছে যা ছোট ছোট মাছ পর্যন্ত ছেঁকে নিয়ে আসে। জালের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
জেলে সম্প্রদায়কে আমরা মৎস্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি। গত বছর বছর প্রত্যেক জেলেকে পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে, মাছ ধরার জালও সরবরাহ করেছি।
আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা ফেরাতে আপনার পরিকল্পনা।
কারার সাইফুল ইসলাম : নাব্যতা আসলে যুগ যুগ ধরে হারাচ্ছে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর জেলা পরিষদের জেলা উন্নয়ন কমিটির প্রথম সভায় নাব্যতা নিয়ে কথা বলেছি। এক সময় লঞ্চে করে ভৈরব যেতাম। এখন চর পরে যাওয়ায় এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। মূল নদী ঘোড়াউত্রার মোহনা থেকে সোয়াইজনি, নরসুন্দা হয়ে ষাইটধারের আখড়া পর্যন্ত নদী খননের জন্য প্রস্তাব করেছি। অলরেডি এটা জাইকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নদী খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জাইকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বরুলিয়া খালের পানিও শুকিয়ে যাওয়ায় খননের জন্য জাইকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মূল নদী ঘোড়াউত্রা সিংপুর গিয়ে নাম নিয়েছে ধনু। প্রতিবছর সিংপুর গ্রামের কিছু অংশ নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। এদিকে ছাতিরচরও আস্তে আস্তে ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে যাচ্ছে। ছাতিরচর ইউনিয়নের গ্রামগুলোকে বাঁচানোর জন্য নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে চিপালিয়া খাল দিয়ে বাইপাস করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। আশা করি এই শুকনা মৌসুমেই কাজ শুরু হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলায় দুইবার সেরা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে কিছু বলুন।
কারার সাইফুল ইসলাম : প্রাথমিক শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য ২০১০ ও ২০১৩ সালে আমি কিশোরগঞ্জ জেলায় সেরার পুরস্কার পেয়েছি। নিকলী শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি পশ্চাৎপদ এলাকা। ১৯৯৯ সালে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল স্থাপন করেছি। যার আলোকে আজ নিকলীতে ১৭টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসায় সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করেছি। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ সুবিধা আছে সেগুলোতেও অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ রাখা হয়েছে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগেও শিক্ষার মান বাড়াতে সচেষ্ট ছিলাম।
কলেজে আইসিটি ক্লাসের সময় কখনো বিদ্যুৎ থাকে না। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় কি?
কারার সাইফুল ইসলাম : সরকারিভাবে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিকল্প ব্যবস্থার কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। তবে নিকলীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য একটা সাব-স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। পিডিবি ও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির সাথে আলোচনা হয়েছে। এই অর্থবছরেই এর কার্যক্রম শুরু হবে।
নিকলীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলবেন।
উত্তর : এক সময় ২৬ কিলোমিটারের দূরত্বে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে যাওয়ার জন্য ভোরবেলা রওনা দিয়ে গচিহাটায় ৭টার ট্রেন ধরতে হতো। মিস হলে আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে তারপর যেতে হতো। এখন রাস্তার ব্যবস্থাপনা এমন হয়েছে যে, রাতদিন যে কোনো সময় প্রয়োজনে কিশোরগঞ্জ আসা-যাওয়া সম্ভব। ঢাকা যেতে হলে লঞ্চে করে ভৈরব গিয়ে, ওখান থেকে বাস/ট্রেনে করে যেতে হতো। এখন জারুইতলার ভেতর দিয়ে রাস্তা হওয়ায় সরাসরি সড়ক পথে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও সাবেক সচিব কারার মাহমুদুল হাসানের সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে।
সদর ইউনিয়নের সাথে অন্যান্য ইউনিয়নের যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে ৪টি ব্রিজ নির্মাণ করেছি। নিকলী-করিমগঞ্জ রুট ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা হাতে নিয়েছিলাম। ক্ষমতার পালাবদলে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর মাননীয় সংসদ সদস্য আলহাজ আফজাল হোসেন ও সাবেক সচিব কারার মাহমুদুল হাসান সাহেব চেষ্টা করছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও নিজ দফতর থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছেন এই রুটটি নির্মাণের ব্যাপারে। আমরা আশাবাদী নিকলী-করিমগঞ্জ সংযোগ সড়কটি এ বছর বরাদ্দ পাবো।
নিকলী থেকে সিংপুর পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হবে; সিংপুর বাজার হয়ে ভাটিবরাটিয়া রাজঘাট পর্যন্ত সড়কটি এই শুকনো মৌসুমেই নির্মাণ শুরু করা হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সিংপুরকে বন্দরে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। উপজেলা সদরকে প্রকৃত শহরে রূপান্তরের জন্য যা যা করণীয় সব করা হচ্ছে। মাননীয় সংসদ সদস্য বিভিন্ন খাত থেকে প্রচুর বরাদ্দ দিচ্ছেন।
নিকলী-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। নিকলীর দরগাহাটি থেকে শুরু হয়ে এটি অষ্টগ্রাম-দিঘিরপাড় সংযোগ সড়কে গিয়ে মিলিত হবে। ইতোমধ্যেই টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়ে গেছে। অচিরেই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান ও ব্যক্তি কারার সাইফুল ইসলামের মূল্যায়ন করবেন।
কারার সাইফুল ইসলাম : ব্যক্তি কারার সাইফুল ইসলামই জনগণের ভোটে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান। যেহেতু আমি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আগেও কাজ করেছি। তাই পার্থক্য তেমন উপলব্ধি হয় না। জনগণের সেবক হিসেবে আছি, শাসক হিসেবে নই। সবার সাথে একই রকম মিলে মিশে চলি।
শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের নিকলী ডটকম-কে সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
কারার সাইফুল ইসলাম : আমাদের নিকলী ডটকম-এর সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে ধন্যবাদ। আশা করি, নিকলীর স্থানীয় প্রকাশনা হিসেবে আমাদের নিকলী ডটকম অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
সাক্ষাতকারের প্রথম পর্ব দেখতে ক্লিক করুন