উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যেতে চায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মোকারম

আবদুল্লাহ আল মহসিন ।।
নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ ডিগ্রী কলেজের একাদশ শ্রেণীর মানবিক বিভাগের ছাত্র মোকারম। এ কলেজের একমাত্র দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছাত্র সে। পিকআপে করে প্রতিদিন ১৪ কিলোমিটার যাতায়াত করতে হয়। বাড়ি কটিয়াদী উপজেলার পশ্চিম সহশ্রাম গ্রামে। বাবা রফিকুল ইসলাম পেশায় রডমিস্ত্রী। মা হোসনে আরা বেগম গৃহিণী। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মোকারম লড়ছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে।
মোকারমরা ৩ ভাই। তিনজনই জন্মান্ধ। এক পরিবারে ৩জন জন্মান্ধ শিশু হওয়ার পরও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েননি বাবা রফিকুল। আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় মনোবলে বলিয়ান হলেন তিনি। বড় ছেলে মোকারমকে তিনি লেখাপড়া করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মোকারমও এতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
ব্যাপক উৎসাহ থাকার পরও বাধা হয়ে দাঁড়াল গ্রামের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা না থাকা। মোকারমও ভেঙ্গে পড়ার পাত্র নয়। সিদ্ধান্ত নিলো পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনে অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হবে। অবশেষে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ঢাকায় এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি হলো সে। সেখানে ১ম থেকে ৫ম শ্রণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি ব্রেইল-এ। তারপর ২০০৯ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয় নরসিংদীর এক স্কুলে। অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে দেখা দিলো নতুন সমস্যা।
ব্রেইল পদ্ধতির বই পাওয়া যাচ্ছে না। নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিলো, কাউকে দিয়ে রেকর্ড করিয়ে তা শুনে শুনে পড়াশোনা চালানোর। রাত-দিন কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ জেএসসিতে জিপিএ-৪.৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। পরিবার আর শিক্ষকদের উৎসাহে মেধাবী এই ছাত্র লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলো। একই স্কুল থেকে ২০১৪ সালে জিপিএ-৩.৯০ পেয়ে এসএসসি পাস করে। অদম্য বাসনা আর কঠোর অধ্যবসায় সে এবার সিদ্ধান্ত নিলো কলেজে পড়ার। অনলাইনে ভর্তি আবেদনের সময় তার পছন্দের কলেজ নির্বাচন হলো নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ ডিগ্রী কলেজ। বাড়ির কাছের গচিহাটা কলেজ রেখে এক বুক স্বপ্ন ও ভাল সুবিধা পাওয়ার আশায় নিকলীতে ভর্তি হয়।

সহপাঠী বন্ধুদের সাথে মোকারম
সহপাঠী বন্ধুদের সাথে মোকারম

মোকারম জানিয়েছে, তার আর্থিক অবস্থা ও মানবিক দিক বিবেচনা করে নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজের প্রিন্সিপাল কারার মাহমুদা পারভীন তার বেতন মওকুফ করার সম্মতি প্রকাশ করেছেন।
মোকারম জানালো, যাতায়াতে তার বেশ সমস্যা হচ্ছে। একদিকে আসা-যাওয়া করতে হয় পিকআপ-এ করে। যাত্রীসংখ্যা বেশি থাকায় ভিড়ের মধ্যে উঠতে-নামতে সমস্যা হয়। প্রতিবন্ধীর জন্য নির্ধারিত সিট না থাকায় কখনো দাঁড়িয়ে যেতে হয়। ছাত্র হিসেবে তার কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিতে অনুরোধ জানালেও এ নিয়ে পিকআপের লোকজন দুর্বব্যবহার করে। দরিদ্র পরিবারের সদস্য হওয়ায় ভাড়া জোগাড়ের ওপর নির্ভর করে কলেজে আসা-যাওয়া।
শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও মোকারমের স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে মোকারম। মনের চোখেই রঙিন এ আলোর ভুবন নির্মাণ করছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোকারম।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!