সবাই দেয়, কেউ নেয় না, ব্যাংকে ‘নিষিদ্ধ’
মো: আল আমিন, কিশোরগঞ্জ
পাঁচ টাকা, দুই টাকা ও এক টাকার ধাতব কয়েন। পাশাপাশি পাঁচ টাকা ও দুই টাকার কাগুজে নোট। এগুলো নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। একেক জন ব্যবসায়ীর কাছে লাখ টাকার এসব মুদ্রা জমে আছে। সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকই গ্রহণ করছে না এসব কয়েন ও নোট। ব্যবসায়ীরা যাদের কাছ থেকে মালামাল কিনেন, সেসব কোম্পানিও নেয় না এ ধরনের মুদ্রা। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা শতকরা ১২ থেকে ১৫ টাকা ‘বাট্টা’ দিয়ে এসব মুদ্রা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাও আবার বাকিতে। ফলে ব্যবসায়ীদের ‘গুড়ের লাভ পিঁপড়ে খাচ্ছে’ অবস্থা।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের বড়বাজারে গিয়ে কয়েকটি বড় দোকানে দেখা গেছে বিভিন্ন অঙ্কের ধাতব মুদ্রা এবং ছোট অঙ্কের কাগুজে মুদ্রা জমে আছে। এসব মুদ্রা সিনথেটিক ব্যাগ, বস্তা এবং কাগজের কার্টনে ভর্তি করে গুদামে ফেলে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। কেবল বড় ব্যবসায়ী নন, ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীরাও আছেন এ সমস্যায়।
বড়বাজারের আলিফ স্টোরের মালিক খুচরা মুদি ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম জানান, তার কাছে ক্রেতাদের কাছ থেকে এক মাসে ধাতব মুদ্রা জমেছে প্রায় ৪০ হাজার টাকার। একজন ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীর কাছে যদি এত টাকা অলস পড়ে থাকে, তাহলে তিনি ব্যবসা করবেন কী করে, এই প্রশ্ন আলমের।
সুবোধ বিড়ি ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার রতন কুমার দাস জানান, প্রায় সারা দেশেই তাদের ফ্যাক্টরির বিড়ির সরবরাহ করা হয়। ফলে প্রতিনিয়তই প্রচুর কয়েন এবং ছোট নোট জমা হয়। কিন্তু এসব কয়েন এবং নোট ব্যাংকে জমা নিতে চায় না। ফলে প্রায়ই শতকরা ১২ থেকে ১৫ টাকা লোকসানে এসব টাকা অন্যের হাতে তুলে দিতে হয়। গত মাসে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে রংপুরে শতকরা ১২ টাকা লোকসানে ১৫ লাখ টাকার ছোট মুদ্রা পাঠিয়েছেন। এতে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে। এখনো তাদের কাছে দেড় লাখ টাকার কয়েন এবং তিন লাখ টাকার দুই টাকার নোট পড়ে আছে।
বড় বাজারের মুদি ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম জানান, ছোট ব্যবসায়ীর হাতেই সাধারণত ছোট মানের নোট আসে বেশি। মহাজন, কোম্পানি বা ব্যাংকগুলো গরিববান্ধব নয়। তারা গরিবের হাতে থাকা ছোট নোটগুলো রাখে না। তার অভিযোগ, অনেক বেসরকারি ব্যাংক আছে যারা ১০০ টাকার নোটও রাখতে চায় না। আশরাফ জানান, তাদের প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা করতে হয়। সব ক্রেতাই তো আর বড় নোট নিয়ে বাজারে আসেন না। তাই ছোট-বড় সব নোটই তাদের রাখতে হয়। আর এভাবেই ছোট নোটের বোঝা দিন দিন বড় হচ্ছে।
বড়বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ বলেন, এসব টাকা সবাই দেয়, কেউ নেয় না। ব্যাংকেও ‘অলিখিত নিষিদ্ধ’।
বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি জানান, বড়বাজারে ছোট-বড় প্রায় এক হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের সবার কাছেই প্রতিদিন প্রচুর কয়েন এবং ছোট কাগুজে মুদ্রা জমা পড়ে। প্রতি মাসে বড়বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছেই ৫ থেকে ৮ কোটি টাকার কয়েন এবং ছোট কাগুজে মুদ্রা জমা হয় বলে তিনি ধারণা দেন। ওসমান গণি বলেন, এটি সম্ভবত কিশোরগঞ্জের সমস্যা নয়, সারা দেশের একই সমস্যা। এ বিষয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু একটা করা উচিত।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ জনতা ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক আহাম্মদ হোসেন স্বীকার করেন, তারা কয়েন জমা নেন না। দুই টাকা পাঁচ টাকার নোট নেন, তবে খুব সীমিত পরিমাণে। স্ট্রং রুমের স্থান সঙ্কুলানের সঙ্কট হয় বলে এসব মুদ্রা নেন না বলে তিনি জানান।
তবে এ বিষয়ে বড়বাজারের একটি বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে ব্যক্তিটি ব্যাংকে ছোট নোট জমা দিতে চান। তিনি আবার যখন টাকা তোলতে আসেন, তখন তাকে ছোট নোট দিলে নিতে চান না। কাজেই দোষ কেবল আমাদের নয়, গ্রাহকদেরও। তারা যদি ছোট নোট নিতেন, তাহলে ব্যাংকগুলোও নিত। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী দিন শেষে বেসরকারি ব্যাংকের টাকা সোনালী ব্যাংকে রাখতে হয়। সোনালী ব্যাংক কিন্তু তাদের কাছ থেকে ছোট নোট গ্রহণ করতে চায় না। এ কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ছোট নোট নেয় না। আর ধাতব মুদ্রা বা কয়েন তো প্রশ্নই ওঠে না।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক কিশোরগঞ্জ শাখার অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার সাইফ উদ্দিন সবুজ বলেছেন অনেক সমস্যার কথা। প্রথমত, বেসরকারি ব্যাংকসহ সবাই যদি এক হাজার টাকা করেও কয়েন বা ছোট নোট জমা দেন তার ব্যাংকের ভল্টে রাখার জায়গা হবে না। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উল্লেখ করে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, ছোট নোট সবাই দিতে চায়। নিতে চায় না। তবে সমস্যাটি গুরুতর বলেও মন্তব্য করে তিনি বলেন, কয়েন বা ছোট নোটের ব্যাপারে কেবল সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকই পারে সমাধান দিতে।
সূত্র : নয়া দিগন্ত, ২ নভেম্বর ২০১৫
ছবি : লেখক