অধ্যাদেশ
মহিবুর রহিম
একদা শৈশবে সব রকমের নৈরাশ্যকে নিজের জন্যে নিষিদ্ধ করে ছিলাম
আজও সেই অধ্যাদেশ বলবত রেখেছি
কতদিন প্লাবিত দুঃখের সমুদ্রকে বলেছি
আমি পর্বতের সন্তান
নিজস্ব নির্ভরতার শৃঙ্গ আছে আমার সত্ত্বায়
যখন অনন্ত যুদ্ধের ডামাডোল বাজায়
মেকি সভ্যতার নাকারচিরা
পৃথিবীর সহনশীলতাকে লেপ্টে দেয়
মানুষের রক্তে ক্ষোভে দুঃখে
আমি কান্নার অশ্রুতে লাগিয়ে দিই
পরম আশাবাদের আরও একটি চারাগাছ
মন্দার গোধূলি বেলা শবযাত্রা নিয়ে আসে
আমাদের বস্তির সেই সকরুণ রাস্তা বরাবর
মুমূর্ষু গণতন্ত্রের অনাথ বোনটি ভবিষ্যত
আশঙ্কায় কান্না জুড়ে দেয়
আমি তাকে বলতে পারি না আগামীকালও সূর্য উঠবেই
তবু আমি আমার আদি শেকড়ের আস্থাটুকু টলাতে পারি না
আমার বিক্ষত বুক জুড়ে লেপ্টে থাকে সেই
আশাবাদের অনড় অধ্যাদেশ।
খেয়ালিপনার হাত ধরে
শৈশবে দূরের মাঠ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম এক দুরন্ত খেয়ালিপনা
আর তাকে ভালবেসেছি অজান্তে
ভাতশালিকের ছানার মতো তাকে পুষেছি আজীবন
আমাদের গৃহপালিত স্বপ্নগুলোর এতটা যত্ন নিইনি কোনদিন
এমন কি আবাদি স্বার্থগুলো অবহেলায় অনাদরে উষর হয়ে পড়েছিলো
আমি সেই খেয়ালিপনার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম প্রিয় নদীদের অন্দর মহলে
স্বচ্ছ নদী আমাকে দেখে তার হাসি চেপে রাখতো
হিজলফুলেরা ঠাট্টা ও মস্করায় লুটিয়ে পড়তো
শস্যমাতা হাওর জননী আমার জন্যে শুধু তার আফসোসের পাল্লা ভারি করতেন
যতটুকু মনে পড়ে আমার খেয়ালিপনা আমাকে অদ্ভূত দুটো ডানা উপহার দিয়েছিলো
যে ডানাতে ছিল যাদুকরী ক্ষমতা
শুধু উড়ার শক্তি নয় যা আমাকে দিয়েছিল স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা
যে কারণে দূরের প্রান্তর মাঠ ও বিলের একাকিত্ব আমি দেখতে পেরেছিলাম
উপলব্দি করতে পেরেছিলাম জলাভূমির ফুলকন্যাদের ভেতরকার সৌন্দর্য
যাদের পাপড়ি আজও আমার চেতনায় লেগে আছে
আমি ভরা যৌবনা ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে
এক মহা মানচিত্রের সম্ভাবনাময় বুকে পা রাখলাম।
কবির জন্ম
ভোরের পৃথিবী গান ধরেছে
বহুবর্ণিল আলোতে তার সুর
বাণী লাভ করেছ হাস্যোজ্জ্বল গুলবাগ
বুক বেয়ে নেমে এলো একগুচ্ছ সার্থকতা!
আজ তবে রচিত হোক একটি মরমী গান
অন্তমিলের খুশবো ছড়িয়ে পড়ুক চারদিকে
কিছু অর্থালঙ্কার পড়িয়ে দাও প্রেয়সী জীবনকে
যেন সে জন্ম দিতে পারে কোন শুদ্ধতম চেতনাকে!
দেখো, এখনো মনের পাপড়িতে লেগে আছে পবিত্র শিশির
সবুজ ক্লোরফিলগুলোর ভিতরে
দানাপানি বেঁধে আছে অনাগত সময়ের বাণী
এরই জন্যে পাঠানো হয়েছে সম্ভাবনাময় ভোর
নাজিল করা হয়েছে অফুরন্ত আলোর রহস্য
প্রস্তুত হয়ে আছে এই মায়াবতী দুনিয়া
ও প্রেমের তন্তুকণা
আশা ও ভালবাসার গোপন সুষমা
আজ এই আলোর সন্তান বুকে নাও
তাকে দাও অপার্থিব বাণীর দুগ্ধস্রোতধারা
কেননা সেই আমাদের অনাগত কালের কবি।
অভিজ্ঞতা
মনে হচ্ছিল, কৌশলী সমরতন্ত্র এবং কূটনীতির কাছে
হাঁটু গেড়ে বসে আছে নিরীহ সময়!
যেন ভূমধ্য সাগর পাড়ি দেয়া কোন বিষণ্ন উদ্বাস্তু
তার আকাশ কেবলি ছেয়ে আছে হতাশার মেঘে
আমি স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছিলাম
বিতাড়িত অমঙ্গল একরোখা সুখে
তার কালো কুৎসিত লেজটুকু নাড়ছিল
মানব স্বপ্নের মাঠ আহা কী রক্তাক্ত
চিরায়ত প্রত্যাশার লাঞ্ছিত ক্ষত-বিক্ষত দেহ
ক্ষুধার্ত বিধ্বস্ত সব জীবনের সামনে
সভ্যতার নামে তারা একেকটা মূলা ঝুলিয়ে রেখেছিল
এই সব সন্ধিক্ষণ শতাব্দীগুলোকে
নতুন ভোরের কোন সংবাদ দিতে অনাগ্রহী
যান্ত্রিক তাড়না ছাড়া কোনরূপ সহনশীলতা দিতে অনাগ্রহী
তরতাজা পৃথিবীকে মনে হচ্ছিল জিম্মি
আর সব ঘটনাগুলোকে মনে হচ্ছিল ফিল্মি
আরোপিত মন্দা, যুদ্ধ এবং ধ্বংস একটা কৃষ্ণ গহ্বরের মতোই সর্বগ্রাসী
চোখ মুছে আমি দেখলাম সারে তিনশ বছরের রেখা মুছে গেল
দিগ্বিজয়ীদের পরিত্যক্ত কবর থেকে উড়ছিল ব্যবিলনীয় ধূলো
দীর্ঘ এক সহস্রাব্দের পর
সময়ের ভেঁজা হাতে আরও একটি সম্ভাবনার শিশু!
মানুষ সন্ধান
মাঝে মাঝে মনে হয় এখনো মানুষ আছে হয়তো কাছেই
হয়তো দূরের কোন জনপদে কোন মহানগরীর ভিড়ে করুণ বস্তিতে
আমি মানুষের গন্ধ চারপাশে অনুভব করি, উতলা আবেগে
অবিকল স্বচ্ছতায় আচ্ছাদিত কল্পনার মতো আজও সৎ ও মহৎ
সরল সুন্দর এক শিল্প হয়ে চলে পথ কঠোর বাস্তবে
হারে না কিছুতে রোজ পদ্ম হয়ে ফোটে পৃথিবীতে
যেখানে অসংখ্য ক্লেদ সভ্যতার বর্বরতা জমেছে ভাগাড়ে।
উৎসর্গ
যে বিশ্বাস আমায় টেনে এনেছে পথে আমি তাকে নিরুৎসাহিত করি না
যে সত্য আমাকে খুলে দিয়েছে দৃষ্টি তার জন্য উৎসর্গ করেছি সত্ত্বা।
যে প্রেম আমার মুগ্ধতার প্রথম ছবক তার জন্য আমি অনন্ত সংগ্রামী
যে প্রকৃতি আমার বোধের জননী তার জন্য হেঁটে চলেছি তিন শত যুগ…..
খেয়ালিপনার হাত ধরে
শৈশবে দূরের মাঠ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম এক দুরন্ত খেয়ালিপনা
আর তাকে ভালবেসেছি অজান্তে
ভাতশালিকের ছানার মতো তাকে পুষেছি আজীবন
আমাদের গৃহপালিত স্বপ্নগুলোর এতটা যত্ন নিইনি কোনদিন
এমন কি আবাদি স্বার্থগুলো অবহেলায় অনাদরে উষর হয়ে পড়েছিলো
আমি সেই খেয়ালিপনার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম প্রিয় নদীদের অন্দর মহলে
স্বচ্ছ নদী আমাকে দেখে তার হাসি চেপে রাখতো
হিজলফুলেরা ঠাট্টা ও মস্করায় লুটিয়ে পড়তো
শস্যমাতা হাওর জননী আমার জন্যে শুধু তার আফসোসের পাল্লা ভারি করতেন
যতটুকু মনে পড়ে আমার খেয়ালিপনা আমাকে অদ্ভূত দুটো ডানা উপহার দিয়েছিলো
যে ডানাতে ছিল যাদুকরী ক্ষমতা
শুধু উড়ার শক্তি নয় যা আমাকে দিয়েছিল স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা
যে কারণে দূরের প্রান্তর মাঠ ও বিলের একাকিত্ব আমি দেখতে পেরেছিলাম
উপলব্দি করতে পেরেছিলাম জলাভূমির ফুলকন্যাদের ভেতরকার সৌন্দর্য
যাদের পাপড়ি আজও আমার চেতনায় লেগে আছে
আমি ভরা যৌবনা ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে
এক মহা মানচিত্রের সম্ভাবনাময় বুকে পা রাখলাম।
মহিবুর রহিম : কবি, প্রাবন্ধিক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক। সিনিয়র প্রভাষক, চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।