আনিস আলমগীর ।।
বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গন থেকে চলে গেলেন পুরোদস্তর একজন সজ্জন, সৎ, নির্লোভ রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সুস্থ হয়ে ফিরতে পারবেন কিনা সন্দেহ ছিল অনেকের। সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে তার প্রার্থিতা নিয়েও সংশয় ছিল। সে কারণে কিশোরগঞ্জের তার আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়াতে চেয়েছেন তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড় আবেগ নিয়ে বলেছেন, “যতক্ষণ আশরাফের নিঃশ্বাস আছে সেখানে অন্য কেউ প্রার্থী হতে পারবে না।” তাই হয়েছে। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা স্বয়ং আশরাফের জন্য ভোট চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জবাসীর কাছে। তিনি জেলার নেতাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছিলেন, “যেহেতু এখানে সৈয়দ আশরাফ সাহেব অসুস্থ, সবাই মিলে তার জন্য কাজ করে যাবেন, যেন তিনি নির্বাচনে জয়ী হন। সুস্থ হয়ে তিনি যেন আমাদের মাঝে ফিরে আসেন এই দোয়া করছি।”
সৈয়দ আশরাফ জয়ী হয়ে এসেছেনও- তার এলাকার মানুষের ভালোবাসায়। সবাই যখন ৩ জানুয়ারি ২০১৯ এমপি হিসেবে শপথ নিলেন, দলের তিনিই ছিলেন একমাত্র অনুপস্থিত। তাকে শপথের জন্য সময়ও বাড়িয়ে দেয়ার কথা হয়েছে। কিন্তু সব কিছু রেখে সেইদিন দিবাগত রাতেই পরপারে চলে গেলেন সৈয়দ আশরাফ। শপথ নেয়া হল না পরপর পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত সৈয়দ আশরাফের। তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ব্যাংককের একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল ক’মাস ধরে। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সৈয়দ আশরাফ এমপি, মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তার আরেকটি পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র। শেখ হাসিনার মতো সৈয়দ আশরাফেরও রয়েছে একটি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক পারিবারিক অতীত। ১৯৫৭ সনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশকে যখন পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়, সে কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন সৈয়দ আশরাফের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম। একইসঙ্গে তিনি ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সভাপতিও ছিলেন। ১৯৬৬ সালে ইডেন কাউন্সিলে যখন শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন, যেখানে ৬ দফা পাস হয়, তখনও সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, ১৯৬৬-এর পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে থাকলেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে জেলে জেলেই জীবন কাটাতে হয়েছে। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। মুজিবনগর সরকার পর্যন্ত আমরা এই ধারাবাহিকতা দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন আর তার অবর্তমানে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হলেন সৈয়দ নজরুল। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও বক্তৃতা করেছিলেন। ইতিহাসবিদদের মতো তার সে বক্তৃতাটিও ছিল ঐতিহাসিক। সেটা দেখলে এই প্রজন্মের জানতে সুবিধা হতো কত বড় নেতা ছিলেন তিনি, কত ত্যাগ ছিল তার এই দেশের জন্য।
বঙ্গবন্ধু এবং সৈয়দ নজরুল যেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামে কাজ করেছেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং সৈয়দ নজরুলের ছেলে সৈয়দ আশরাফের সংগ্রামটাও অনেকটা সেরকম। সৈয়দ আশরাফ সে কারণেই বলতে পারেন আওয়ামী লীগ শুধু রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ একটা অনুভূতি। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, শেখ হাসিনাকে যখন জেলে যেতে হয়, তখন আওয়ামী লীগের এক সংকটকালে তিনি দলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আব্দুল জলিল যখন গ্রেফতার হন, তখন সৈয়দ আশরাফুল আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
একজন দক্ষ সংগঠক, একজন নির্লোভ রাজনীতিবিদ, পরিমিত কথার যাদুকর এবং রাজনীতিতে সুস্থধারার অনুসারী হিসেবে তিনি পরিচিতি পান এই সময়টাতেই। রাজনীতিতে তার আগমন অবশ্য বাংলাদেশের জন্ম থেকেই বলা চলে। ১৯৭১ সালে অল্প বয়সেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগ দেন। ছাত্রজীবন বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তার পিতাকে যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আওয়ামী লীগের আরও তিন জন নেতার সঙ্গে হত্যা করা হয়, তারপর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম লন্ডনে চলে যান। সেখানেই ছিল তার বসবাস। কিন্তু ফিরে এসে পুরোপুরি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন ১৯৯৬ সাল থেকে। সৈয়দ আশরাফ ১৯৯৬, ২০০১, ২০১৪ সালেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তার কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর-হোসেনপুর) আসন থেকে। তিনবার তিনি মন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনিই মনে হয় সততার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মন্ত্রী হয়ে যার সম্পদ বাড়েনি; বরং কমেছে। চিকিৎসার জন্য যাকে বিক্রি করতে হয়েছে নিজের বাড়ি।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি মিডিয়ার কাছে সহজ ছিলেন না, এটা তার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ ছিল। মন্ত্রীর দপ্তরে সব সময় থাকতেন না, এমনও অভিযোগ ছিল। কিন্তু ৫ মে ২০১৩ সালে তিনি প্রমাণ দিলেন প্রয়োজনের সময় থাকেন তিনি। সেদিন হেফাজত যখন ঢাকা শহরের মতিঝিল এলাকায় অফিসপাড়া, দৈনিক বাংলা মোড়, পল্টন, সিপিবি অফিস পুড়িয়ে শ্মশান বানিয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছিল কোনও বড় নেতাকে পাওয়া যায়নি পার্টি অফিসে, মন্ত্রীর দেখা মিলেনি মিডিয়ায়। হেফাজত যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা ঘুড়িয়ে দেয়ার, শাহবাগে আক্রমণ করার হুংকার দিয়ে এগুচ্ছে- একজন সৈয়দ আশরাফ মাঠে আবির্ভূত হয়ে ঘোষণা করলেন, “আজ রাত ১০টার মধ্যে হেফাজতিদের চলে যেতে হবে এবং যেতে হবে। না হলে, সরকার বিন্দুমাত্র আর ছাড় দিবে না।” তাই হয়েছিল। বুকের উপর থেকে পাথর সরে গিয়েছিল নগরবাসীর। নিঃশ্বাস নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিল তারা। হেফাজতিদের ছাড়তে হয়েছে রাজধানী ঢাকা।
সৈয়দ আশরাফের রাজনীতিতে তার থাকা না থাকা নিয়ে নানা সময় নানা গুঞ্জন ছিল। তিনি ১৯৯৬ সালে ছিলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে ছিলেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী। বিরোধী দলে থাকতেও ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তবে তাকে নিয়ে রাজনীতির আকাশে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় ২০১৫ সালে। সে বছর ৯ জুলাই দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেন। এক মাস এক সপ্তাহ দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকার সেই অনিশ্চয়তাকালে সৈয়দ আশরাফ মিডিয়ার কাছে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘গুজবে কান দেবেন না’। কিন্তু গুজবই যখন শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেয় তখন মুখ লুকানোর আর জায়গা থাকে কই! জায়গা সেকেন্ড হোম- লন্ডন। বিলাত থেকে আসা লোক বিলাতেই ফেরত যেতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত মুখ লুকাতে হয়নি। মুখ উজ্জ্বল করা সমাধান মিলেছে। বৃষ্টির ভরা মওসুমে ‘সৈয়দ আশরাফ’ নামক একটা রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টি করে, কয়দিন চায়ের কাপে তুমুল ঝড় তোলার সুযোগ দিয়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই আবার তা ভোঁতা করে দিয়েছিলেন- ১৬ জুলাই ২০১৫ নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সৈয়দ আশরাফকে দিয়ে।
ঝড়ের গতি থেমে গেলেও ওয়ান/ইলাভেন পরবর্তী দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন সেইই প্রথম জনসম্মুখে এসেছিল। এটা কি দলের সভাপতির সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের বিরোধ, নাকি এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণ আছে তার বিশ্লেষণও হয়েছে বিস্তর। সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক যে বিরোধী দলের কাছেও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি তা তখন নতুনভাবে জানা গিয়েছিল। অনেক সাধারণ লোকও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এভাবে সরকার থেকে বিদায় নেয়াকে সমর্থন করেনি। গম কেলেঙ্কারির পরও কামরুল ইসলাম এবং উচ্চ আদালতে সততা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও মোফাজ্জল হোসেন মায়া মন্ত্রিসভা থেকে যখন বাদ পড়ল না, বাদ পড়ল যার সততা প্রবাদপ্রতিম সেই সৈয়দ আশরাফ- সে কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠেছিল। দলের মধ্যে শেখ হাসিনা এবং সৈয়দ আশরাফের বোঝাপড়া দারুণ সম্মানের ছিল। তাদের টিমটাও সেইরকম কাজ করেছে। সৈয়দ আশরাফকে ফিরিয়ে না আনা হলে স্পষ্টতই সেটা টিমের ভাঙন হিসেবে দেখা হত।
আওয়ামী লীগ যুগ যুগ টিম হিসেবে ভাল করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করছিলেন, তখন তার ছিল একটি শক্তিশালী টিম। এই দক্ষ দলটি শেখ মুজিবকে একজন প্রকৃত নেতা হিসেবে পুরো পাকিস্তানকে চেনাতে সহায়তা করেছে। এই টিমটিই সুখে-দুঃখে শেখ মুজিবের পিছনে ঐক্যবদ্ধ ছিল, যার কারণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত যেতে পেরেছেন।
সৈয়দ আশরাফ এবং শেখ হাসিনার মধ্যে যে সুসম্পর্ক এবং সম্মানজনক সম্পর্ক ছিল সেটি রাজনীতিতে বিরল। ২০১৬ সালে যখন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ছাড়েন সেটিও ছিল অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে। শেখ হাসিনা বুঝেছিলেন দলের জন্য যেটুকু সময় দেয়া দরকার সেটি সৈয়দ আশরাফের পক্ষে সম্ভব না, অথচ সামনে নির্বাচন। তার স্ত্রী ছিলেন অসুস্থ। ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীকে লন্ডনে দেখাশোনার বিষয় ছিল। ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর তার স্ত্রী শিলা ইসলাম মারা যান।
সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনের আগাগোড়া তিনি ছিলেন না। তেমন অবদানও রাখতে পারেননি। তবে সৈয়দ আশরাফ ১/১১ থেকে দলের যে হাল ধরেছিলেন, শেখ হাসিনার হাতকে যেভাবে শক্তিশালী করেছেন, সেই ধারাবাহিকতায় তার অবদান রয়ে যাবে। দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তো বটেই, আওয়ামী লীগের একজন সজ্জন নেতা হিসেবে, সৎ নেতা এবং সর্বোপরি মর্যাদাজ্ঞান সম্পন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি দল মত নির্বিশেষে সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে ছিলেন, আগামীতেও রোল মডেল থাকবেন। সুস্থধারার রাজনীতির জন্য তার মতো নেতার এখন বড়ই আকাল। তার চলে যাওয়া সেই স্থানের শূন্যতা আরও বাড়িয়ে দিল।
সূত্র : বিডি নিউজ, ৪ জানুয়ারি ২০১৯