আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা বিশেষ দিবসকে তোপধ্বনির (কামান দাগা) মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়। ঐতিহাসিকভাবে সামরিক বাহিনীর এই তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্মান জানানোর রেওয়াজ রয়েছে। তোপধ্বনির মাধ্যমে সামরিক অভিবাদনের প্রথাটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত। তোপধ্বনির সংখ্যার বিষয়টিও এসেছে ঐতিহাসিকভাবে। এটি ব্যক্তি বা ক্ষেত্রবিশেষে কম-বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে তোপধ্বনির মাধ্যমে শ্রদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক অভিবাদন জানানো হয়। দু’টি দিনেই ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়। আবার বাংলাদেশে অন্য কোনও দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান বা আন্তর্জাতিক বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা জানাতে ২১ বার তোপধ্বনি দেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী সামরিক সম্মান জানাতে ২১ বারই তোপধ্বনি করার বিষয়টি জানা যায়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা গেছে, এই তোপধ্বনি দেয়ার রীতির শুরুটা হয়েছিল চতুর্দশ শতকে। ওই সময় নৌবিদ্যায় পারদর্শীরাই পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব করতো। ফলে অধিকাংশ যুদ্ধই হতো নৌ-পথে। কোনও যুদ্ধজাহাজে গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে রিলোড করা পর্যন্ত সেটি অসহায় থাকতো। এ অবস্থায় জাহাজটি স্থলভাগের সৈনিকদের কামানের গোলার মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইঙ্গিত দিতো। তাই বিদেশের বন্দরে যখন কোনও যুদ্ধজাহাজ প্রবেশ করে তখন এভাবে তোপধ্বনি দিয়ে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককেই সম্মান প্রদর্শন করে।
আবার ওই সময় কোনও জাহাজ যখন যুদ্ধের জন্য বন্দর ছেড়ে যেতো তখন স্থলভাগ ও জাহাজের ভেতর দুই স্থান মিলিয়ে মোট ২১ বার তোপধ্বনি দেয়া হতো। পরবর্তীতে এই ২১ বারের তোপধ্বনির বিষয়টি একটি চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এটি বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে।
৩১ বারের তোপধ্বনির ব্যাখ্যায় জানা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে ২১ বার তোপধ্বনি প্রচলন থাকলেও ব্রিটিশ উপনিবেশিক দেশগুলো এই নিয়মে কিছুটা পরিবর্তন এনে ৩১ বার নির্ধারণ করে। বিষয়টি এমন যে, যখন কোনও যুদ্ধজাহাজ বন্দর বা ঘাঁটি ছেড়ে বের হয় তখন সেই জাহাজ থেকে ৭ বার তোপধ্বনি দেয়া হয়। ঘাঁটিতে বা বন্দরে অর্থাৎ মাটিতে সৈনিকদের যে দল বা ব্যাটারি থাকে তারাও সেই তোপধ্বনির জবাবে ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে। জাহাজ থেকে ৭ বার, মাটি থেকে ২১ বার মোট ২৮ বার তোপধ্বনি করার পর জাহাজ থেকে আরও তিনবার তোপধ্বনি করা হয়। সেই অতিরিক্ত তিনটি তোপধ্বনির একটা করা হয় ব্রিটিশ রাজা বা রানির সম্মানে, অন্যটা জাহাজের ক্যাপ্টেনের জন্য এবং শেষটা হচ্ছে ব্রিটিশ বাহিনীর রাজকীয় প্রতিনিধির জন্য।
এদিকে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট ছাড়াও ব্রিটিশ ক্রাউন ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজা বা তার প্রতিনিধিদের শ্রদ্ধা জানাতে তোপধ্বনি প্রথা চালু হয়েছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা গেছে, রাজা, নবাব বা জমিদারদের গুরুত্বভেদে এই তোপধ্বনি নির্ধারণ হতো। কোনও কোনও নবাব বা জমিদারের জন্য কোনও তোপধ্বনি বরাদ্দ ছিল না। একমাত্র বড়লাট বাহাদুরই নির্বাচন করতেন কোন রাজার সম্মানে কতগুলো তোপ দাগা হবে। রাজ্যের সমৃদ্ধি, রাজরক্তের কৌলীন্য আর সর্বোপরি ব্রিটিশরাজের প্রতি তাদের আনুগত্যবোধ থেকে তোপধ্বনির সংখ্যা নির্ধারণ হতো। তিনিই তোপধ্বনির সংখ্যা বাড়াতে বা কমাতে পারতেন। যেমন, হায়দ্রাবাদ, কাশ্মির, গোয়ালিয়র, মহিশুর এবং বারোদার রাজার বরাদ্দ ছিল ২১ বার তোপধ্বনির সম্মান। এর ধারাবাহিকতায় কেউ পেত ১৯, কেউ ১৭, কেউ ১৫ কিংবা ৯টি তোপের আখ্যা। আবার কারও অনুকূলে কোন তোপধ্বনি বরাদ্দই ছিলো না।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক বলেন, তোপধ্বনি হচ্ছে প্রচলিত সামরিক সম্মান। এটা ঐতিহ্যগতভাবেই এসেছে। বাংলাদেশে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দেশের সূর্যসন্তানদের সম্মান জানানো হয়। তবে, এই সম্মানের সঙ্গে তোপধ্বনির সংখ্যার সেই অর্থে কোনও সম্পর্ক নেই। কোথাও ৭ বার, কোথাও ২১ বার আবার ৩১ বারও এই তোপধ্বনি হয়।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ জানান, এটি সামরিক সম্মান। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ঘাঁটি ছেড়ে যাওয়ার সময় এই তোপধ্বনির রেওয়াজ শুরু হয়। এটি কখনও ২১ বার আবার কখনও ৩১ বার হয়ে থাকে। আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে সম্মান জানানো হয়। আর যতদূর জানি, ৩১ বার তোপধ্বনির বিষয়টি ব্রিটিশ রেওয়াজ থেকে এসেছে।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন