মো: হেলাল উদ্দিন, বিশেষ প্রতিনিধি ।।
“আলো বলে, অন্ধকার তুই বড় কালো। অন্ধকার বলে ভাই, তাই তুই আলো।” নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে বড় করে তোলে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, এসব প্রেরণায় বলিয়ান কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার জালালপুর গ্রামের জালাল উদ্দিনের পুত্র কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স হিসাববিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র মো: খাইরুল ইসলাম।
হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম খাইরুলের। কঠিনকে জয় করার রয়েছে তার অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিন কলেজের ক্লাস শেষে রাস্তায় অটোরিকশা চালিয়ে এই কলেজছাত্র বর্তমান সময়ে এলাকায় বেশ আলোচিত। গত শনিবার (৩০ মার্চ ২০১৯) রাস্তায় অটোরিকশায় যেতে যেতে কথা হয় তার সাথে।
তুমি কলেজের ছাত্র তবে অটোরিকশা চালাও কেন? খাইরুল জানায়, আমাদের সংসারে ৮ ভাই ১ বোন। আমি জন্মসূত্রে পোলিও রোগে আক্রান্ত। আমার বাম পা অচল। লাঠিতে ভর করে আমি চলাফেরা করি। বাবা-মার ৫ম সন্তান। ২০১৫ সালে নানশ্রী সিংগারপাড় আদর্শ দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং ২০১৮ সালে নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। বাবার ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই।
ভাইদের কায়িক পরিশ্রমে উপার্জিত টাকায় চলে আমাদের সংসার। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর একদিন বাবা আমাকে বললেন, তোমাকে আর পড়ালেখার খরচের টাকা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তোমার পড়ালেখার খরচের ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। বাবার এ কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।
এ সময় ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করবো? লেখাপড়া আমাকে করতেই হবে। এমতাবস্থায় আমি কি করতে পারি, কে দিবে আমায় কাজ! পঙ্গুত্বের অসহায়ত্ব আমাকে পেয়ে বসে। ভাবতে ভাবতে সে দিন রাতে ঘুম খাওয়া কিছুই হলো না আমার। বাবা, মা কাউকে বুঝতে দেইনি আমার কষ্টের দীর্ঘশ্বাসের কথা। ভাবছি কি করবো! কার কাছে যাবো?
কল্পনায় ভাসছে কেবলি অন্ধকার, সাথে নীরবে চোখের পানি। সিদ্বান্ত নিলাম অটোরিকশা চালাবো। ছুটে গেলাম গেরেজে। কিন্তু সেখানেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো আমার পঙ্গুত্ব। গাড়ির মালিক আমাকে গাড়ি দিতে চায় না। অনেক অনুরোধের পর আমার অবস্থা বিবেচনা করে গাড়ি দিতে রাজি হলেন।
ভোর হতে সকাল নয়টা, বিকালে ক্লাস ছুটির পর রাত নয়টা পর্যন্ত, আবার কলেজ বন্ধের দিনগুলোতে সারাদিন সে গাড়ি চালায়। প্রতিদিন গাড়ির জমা খরচ ৫০০ টাকা মালিককে দিতে হয়। এখন খাইরুল আর গ্রামের বাড়িতে থাকে না। পড়াশোনা ও কাজের সুবিধার জন্যে বাসা ভাড়া নিয়ে জেলা শহরে বাস করে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র।
কখনো কি মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করেছ? সরলতা আর আত্মসম্মানবোধ থেকে জানালো, এ কাজটিতে আমি লজ্জা পাই। তাছাড়া নিজের সামর্থ্য খাটিয়ে উপার্জন করার চেষ্টা করি। কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে চেয়ে নেয়া থেকে শ্রমের বিনিময়ে অর্জন করাটা অনেক সম্মানের।
সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড পাওয়ার কথা জানিয়ে খাইরুল বলছিলো, তিন মাস অন্তর দুই হাজার একশত টাকা করে তারা দেয়। এ টাকায় কলেজের বই, খাতা, কলম, পরীক্ষার ফি কিছুই হয় না। এর সাথে অটোরিকশা চালিয়ে যাবতীয় খরচ চালাই।
শিক্ষাজীবনে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহযোগিতার ব্যাপারে জানা গেলো, অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় আমার কাছ থেকে ভর্তি ও ফরমফিলাপের টাকা কম নিয়েছে।
খাইরুল সম্পর্কে জানতে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন এই প্রতিনিধি। এর মধ্যে নানশ্রী সিংগারপাড় আদর্শ দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আব্দুল আউয়ালের সাথে কথা হয়। তিনি জানালেন, খাইরুল মেধাবী ছাত্র। তার আচার-আচরণ খুবই ভালো। দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষায় কিছুটা পেছনে ছিল। আমাদের বিশ্বাস একদিন সে ভালো কিছু করবে।
পড়ালেখায় খরচ যোগানে অপারগতা জানালে বাবার প্রতি খাইরুলের কোনো কষ্টবোধ বা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়নি। বাবা-মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা বোধ রেখে জানালো, তাঁদের যতটা সামর্থ্য রয়েছে এর সর্বোচ্চই আমার জন্যে করেছেন। পড়ালেখা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে বাবা-মা ও পরিবারের সবাইকে সহযোগিতা করতে চাই। তাদের মুখে হাসি ফুটাতে চাই।
পড়ালেখার পাশাপাশি অটোরিকশা চালিয়ে আয়ের বাড়তি অংশ পরিবারের জন্যে পাঠিয়ে দেই। শিক্ষাজীবন শেষে সরকারি চাকরি করার আগ্রহ রয়েছে খাইরুলের। কথার শেষদিকে অদম্য শিক্ষার্থী খাইরুল সরকারি চাকরি পেতে সুযোগ করে দেয়ার জন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাজে একটা আর্জি রেখেছে। দুর্মূল্যের এই সময়ে জীবনের প্রতিটি স্তরে যুদ্ধ করে টিকে থাকা খাইরুলের সেই “সোনার হরিণ” সরকারি চাকরি অর্জন হোক, সেটাই দেখার বিষয়।