মো: হেলাল উদ্দিন, বিশেষ প্রতিনিধি ।।
হাওর নানা জীব বৈচিত্র্যপূর্ণ, নদ-নদী খাল-বিল, মিঠাপানির মাছ আর উন্নয়নের সংবাদ খবরের কাগজ এবং টেলিভিশনের পর্দায় বার বার উঠে এসেছে। ভাটির শার্দুল হাওরের সিংহমানব যখন দেশের রাষ্ট্রপতি তখন হাওরের জনমানুষেরা অন্ধকারে থাকবে কেন? হাওর এখন আর সেকালের হাওর নয়, হাওর যেন উন্নত জনপদ।
মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকে সরকার চালু করতে যাচ্ছে হাওরে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য “হাওর ভাতা”। ঐতিহ্যময় হাওর অঞ্চল হিসাবে খ্যাত কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দুর্গম এলাকা সিংপুর ইউনিয়নের ধনু নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ডুবি গ্রাম। এ গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা প্রতিদিন ক্ষেতের আইল দিয়ে কাদামাটি ভেঙে কখনো জলাধারে পানিতে পরনের কাপড় প্যান্ট ভিজিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয়।
শিক্ষকদের এ সংগ্রাম দীর্ঘদিন যাবত চলছে। এসব সংগ্রামী শিক্ষকের স্বপ্ন এখন হাওর এলাকায় উন্নয়ন হচ্ছে। একদিন হয়তো হাওরের বুক চিরে তাদের আসা-যাওয়ার রাস্তাটি দৃশ্যমান হতে পারে। ডুবি হতে উপজেলা সদরের দূরত্ব হবে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। নদীপথ ছাড়া এ এলাকার মানুষের জন্য কোনো সড়কপথ নেই।
ডুবি গ্রামে রয়েছে দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অপরটি ডুবি শরিয়ত উল্লাহ দাখিল মাদ্রাসা (এমপিওভুক্ত)। বর্ষা মৌসুমে নৌকা দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে থাকেন। শুকনো মৌসুমে শিক্ষক/শিক্ষিকাগণ বিদ্যালয়ে কার্তিক মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত হেঁটে চলাচল করতে হয়। গ্রামের কোনো রাস্তা না থাকায় বোরো জমিনের আইল দিয়ে প্রতিদিন শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে এসে পাঠদান করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডুবি গ্রামের প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত আছেন তারা জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ হলেন নিকলী উপজেলার টেংগুরিয়ার আব্দুল কদ্দুস (প্রধান শিক্ষক), মজলিশপুরের মো: আদিল, নিকলী সদরের পুকুরপাড় গ্রামের মো: আবিদ। দাখিল মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষকগণ হলেন করিমগঞ্জ উপজেলার বালিয়াপাড়ার মাওলানা মো: আমিনুল ইসলাম (সুপার), একই গ্রামের মৌলভী আবু বাক্কার ও মাওলানা মো: শামছুল ইসলাম, দরগা ভিটা গ্রামের মাওলানা আব্দুল জব্বার, বাইল্লা গ্রামের মাওলানা বজলুর রহমান, কালিকাপ্রসাদ গ্রামের মো: আবুল কাশেম, নিকলী উপজেলার নানশ্রী গ্রামের মো: হেলাল উদ্দিন। কিশোরগঞ্জ সদর লতিফাবাদ গ্রামের তাসলিমা আক্তার, তাড়াইল উপজেলার কাজলা গ্রামের মো: জহির আহম্মেদ।
কথা হয় শিক্ষক আবুল কাশেমের সাথে। তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান, বাড়ি হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার পথ বাইসাইকেলে গুনধর ইউনিয়নের গাংগাটিয়া পর্যন্ত আসি। তারপর জমির আইল দিয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে মাদ্রাসায় পৌঁছতে হয়। যদি গাংগাটিয়া হতে ডুবি পর্যন্ত চলাচলের রাস্তা থাকতো তবে ডুবি প্রতিষ্ঠান দু’টিতে আমরা যারা চাকরি করি অল্প সময়ের মধ্যে কম পরিশ্রমে বিদ্যালয়ে আসতে পারতাম।
ডুবির পূর্ব দিকে মিঠামইন, দক্ষিণে ইটনা, পশ্চিমে করিমগঞ্জ উপজেলা। এসব উপজেলার সাথে ডুবির কোনো সংযোগ রাস্তা নেই। নেই বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো হাট-বাজার। রাস্তা হলেই গ্রামে জমে উঠতে পারে ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। নৌ-পথ ও সড়কপথে অন্যান্য উপজেলার লোকজন এখানে পণ্য বেচাকেনা করতে আসবে।
রাস্তা নিয়ে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের সাথে কথা হলে তারা এ প্রতিনিধিকে জানান, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি করিমগঞ্জের সুতারপাড়া হয়ে গাংগাটিয়া কিশোরগঞ্জ সংযোগ রাস্তা। এ সড়কটি নির্মাণ করা হলে গ্রামের মানুষেরা সহজে জেলা সদর ও সদ্যনির্মিত রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সড়ক দিয়ে অল্প সময়ে উপজেলা সদরে যেতে পারবে। শুধু তাই নয়, জেলা সদরেও যাতায়াত সহজ হবে। রাস্তাটি নির্মাণ করা হলে এ এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, কম খরচে মালামাল কৃষিপণ্য আমদানি ও ধান-চাল রপ্তানি করতে পারবেন। গড়ে উঠতে পারে হাওরে পর্যটক কেন্দ্র।
রাস্তা না থাকার ফলে মানুষের চলাচলে সময়, অর্থ বেশি ব্যয় হয় এবং বৈশাখ মাসে হাওর থেকে ধান নিয়ে কৃষকেরা বাড়ি আসতে পারে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অকাল বর্ষা হলে অনেক সময় তাদের সোনালী ফসল পানিতে নষ্ট হয়।
রাস্তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা হয় ডুবি মাদ্রাসার দশম শ্রেণির আকরাম, নবম শ্রেণির নুরে রাফিয়া, অষ্টম শ্রেণির ইমরান, ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী বর্ষার সাথে। তারা বলেন, আমরা যখন বর্ষা মৌসুমে নৌকা দিয়ে মাদ্রাসায় আসি প্রায় সময় আমাদের নৌকা ডুবে আমাদের বই-খাতা-কলম নষ্ট হয়, কখনো কখনো হারিয়েও যায়। তাই হাওরপিতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভাটির শার্দুল আব্দুল হামিদ এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের স্থপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের প্রাণের দাবি ডুবির মানুষের যাতায়াতের জন্য করিমগঞ্জের গাংগাটিয়া হতে ডুবি হয়ে মিঠামইন পর্যন্ত একটি উঁচু রাস্তা নির্মাণ করে আমাদের উন্নয়নের মহাসড়কের যাত্রী হওয়ার সুযোগ করে দিবেন। আমরা বর্তমান উন্নয়নের সরকারের কাছে তা প্রত্যাশা করি।