নজরুল ইসলাম তোফা।।
বাংলা পঞ্জিকার ১ম মাস বৈশাখের ১ তারিখেই হয় “পয়লা বৈশাখ” বা “পহেলা বৈশাখ”। বাংলা সনের এ দিনটিকেই বলা হয় বাংলা “নববর্ষ”। এমন দিনটিকেই বাংলাদেশের মানুষ খুব উৎসবের সঙ্গেই পালন করে আসছে। শুভ “নববর্ষ” উদযাপনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে থাকে। বাঙালি মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি এবং পুরুষেরা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধানে খুব বিনোদনপূর্ণ ভাবে এ দিনটি উদযাপন করে। আবার প্রত্যেক ঘরে ঘরেই বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি হয়। যেমন- পান্তা-ইলিশ এবং নানা রকমের পিঠাপুলির ব্যবস্থা সহ হরেক রকমের খাবার। সর্বোপরি বলাই যায় যে, সব স্তরের বাঙালি জাতি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথমে ঘরে ঘরে ভালো খাবার খায় এবং মানুষদের প্রতিও ভেদাভেদ দূর করেই যেন মানবতা বোধকে জাগ্রত করে। এমন এই নববর্ষের দিনটিতেই অনেক দরিদ্র, নিপীড়িত, অসহায় মানুষদের পাশাপাশি দাঁড়ানোর প্রেরণার একটি বৃহৎ পটভূমিই বলা চলে। সুতরাং এই দিনটি বাঙালিদের যতগুলো অনুভূতি রয়েছে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে বৈশাখের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। এই পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব তার মাঝেই তীব্র ভালোবাসাটুকু হতে পারে মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা। যারা কখনো নিজেদের এই মাতৃভূমির জন্যে সামান্যতম ভালোবাসাটুকু অনুভব করেনি, তাদের মতো চরম দুর্ভাগা বলতে আর কেউ নেই। এ মাতৃভূমির মাঝে অনেক নদীও রয়েছে। তাই কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার জন্যই এদেশে গড়ে উঠেছে নদীকেন্দ্রীক সংস্কৃতি।
সুতরাং এই সংস্কৃতি কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত এবং ঋতুভিত্তিক মাতৃভূমিতেই বারবার ফিরে আসে ১লা বৈশাখ। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে উৎপাদনের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন ধার্য হয়ে আসছে সুদূর অতীত কাল থেকে। সেই হিসেবে বলা যায়, বাঙালিদের লোকউৎসবের দিন হিসেবেই বিবেচিত। তাই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি মতে, ১৪ই এপ্রিল বা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। যেকোন পঞ্জিকা সেটি আধুনিক অথবা প্রাচীন হোক না কেন হিসাবে অবশ্যই মিল রয়েছে। সুতরাং প্রতি বছর এ দেশে ১৪ই এপ্রিল দিনকে নিয়েই অনেক মানুষ জন উৎসবে মশগুল থাকে। বলা যায় যে, বাংলা সনের গণনার সময় পর্বেই বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর এমন এ সংস্কৃতির শুভ সূচনার দিনই হলো নববর্ষ। বলতেই হচ্ছে, বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এ দিন নির্দিষ্ট করে সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও এ দিনকে নতুন ভাবে তাদের ব্যবসার শুভসূচনার এক উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই বাঙালিরা বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন ভাবে এ দিনটি পালন করতো বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছে। ১লা বৈশাখ দিনটি যতটা ধর্মীয় অনুভূতি সিক্ত, তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিনোদন বিবেচনাটাকেই সামনে আনা যেতে পারে।
বাংলা সনের ইতিহাসের দিকে একটু না গেলেই নয়, নববর্ষটি আসলে পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিসত্ত্বার ঐতিহ্যের একটি বৃহৎ অংশ। অতএব, বাঙালিদের যে সকল ঐতিহ্যকে নিয়ে উৎসব এবং অনুষ্ঠান হয় তা গণমানুষের আত্মার মিলন মেলারই প্রধান হচ্ছে এই বাংলা নববর্ষ। তাইতো সুপ্রাচীন কালেও পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতি শুভ নববর্ষটিকে উৎযাপনে ব্যস্ত ছিল। এখন এসে হয়তো বা একটু বেশী ভাবেই পালন করছে। ‘শুভ নববর্ষ’ বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক বলা যায়। তাই তো বাঙালি জাতি পহেলা বৈশাখটিকে সর্ব বৃহৎ উৎসব মনে করে বিশ্বাসের সহিত এ দিনকে পুরনো বছরের সকল ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে গিয়েই যেন মহানন্দে নতুন বছরটিকে বরণ করে নেয় এবং সুখ ও সমৃদ্ধি আশায় নবজীবন প্রাপ্তির কামনা করে।
ইতিহাস জানা না থাকলে এদিনের তাৎপর্য বিশ্লষণে হয়তো বা একটু অপূর্ণই রয়ে যাবে। ইতিহাসবিদের মতেই বলতে হয়, সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই ঋতুরাজির আবর্তন-বিবর্তনের ধরন সংক্রান্ত জ্ঞান মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। এর পরপরই যেন এসেছে জ্যোতিষ শাস্ত্র। তাই মানুষ দিন, মাস, বছর গণনায় পারদর্শী হয়েছে। আসলে সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা-উড়িষ্যায় ইলাহি সন, ফসলি বা মৌসুমি সন ও বিলায়েতি সনের প্রচলন ছিল। ঘরে ফসল তোলার সময়ে খাজনা আদায়ের যে সময়টি তা সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় বাঙালি জনগণকে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। সুতরাং এ জন্য সম্রাট আকবর তাঁর জ্যোতিষ-শাস্ত্রবিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজিকে দিয়ে হিজরি সনের সঙ্গে যেন সামঞ্জস্য বিধান করেই “তারিখ-ই-ইলাহি” উদ্ভাবন বা প্রচলন করে। পরে বঙ্গাব্দরূপে এটি পরিচিত ও গৃহীত হয়। তখন থেকে বাঙালি কৃষি সমাজের মানুষের কাছেই এই দিনটি সমাদৃত এবং পূজিত হয়ে আসছে।
তাই তো বাঙালি জাতির কন্ঠস্বরেই ধ্বনিত হয় বৈশাখের গান—
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো’…
লেখক : টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং প্রভাষক।