মোঃ হেলাল উদ্দিন, বিশেষ প্রতিনিধি ।।
কিশোরগঞ্জের দুর্গম হাওর অঞ্চল খাল-বিল, নদ-নদী, নালা, জলাধার হিসাবে খ্যাত নিকলী। এখানকার শতকরা ৯৫% মানুষই কৃষক। অত্র উপজেলা এবার প্রায় ১৫ হাজার ৫শত হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। ৫ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে ২৮ব্রি ধান, ৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমিতে ২৯ব্রি ধান, ৩৮০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিট ধান, ৪০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় ধান, ৫০০ হেক্টর জমিতে ৮২ব্রি ধান, ৩ হেক্টর অন্যান্য ব্রি ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য হবে প্রায় ৪২০ কোটি টাকা।
হাওরের কৃষকেরা বছরে একটি মাত্র বোরো ধান বৈশাখী ফসল উৎপাদন করে। নিকলীর হাওর এখন পাকা, কলা পাকা, আধাপাকা অবারিত ফসলের মাঠ। হাওরের যে দিকেই চোখ যায় শুধু শ্রমজীবী মানুষের ঢল। ইতিমধ্যে ধান কাটতে শুরু করেছে এলাকার কৃষাণ-কৃষাণিরা। উপজেলার হাওরগুলোতে শিলাবৃষ্টিতে ও চিটায় ফসলের ক্ষতিতে ধান কাটায় অতীতের যে কোনো সময়ের মতো নেই হাওরে কৃষকের মুখে আনন্দের গান।
হাওরে ধান কাটা পরিদর্শনে গেলে এবারের ফসল উৎপাদনের ব্যয় নিয়ে কথা হয় ছাতিরচরের কৃষক জাকির হোসেন, গোরাদিঘার হামিদ আলী, সিংপুরের রমজান, দামপাড়ার কাশেম, জালালপুরের ফাইজুল, সহরমুলের ছিদ্দিক, নানশ্রীর হাবিবুর রহমানের সাথে। তারা এ প্রতিবেদককে জানান, ৩৫ শতাংশ জমিতে (এককানি) হাওরের আঞ্চলিক হিসাবে ধান ফলাতে চাষীদের খরচ হয় প্রতি কানিতে বীজধান ৫ কেজি মূল্য ২৫০, বীজতলা তৈরির শ্রমিক মজুরি ৩০০, জমিতে হালচাষ (পাওয়ারটিলার) ৬০০, বীজতলা হতে চারা উত্তোলন ২ জন শ্রমিকের মজুরি ৮০০, জমিতে চারা রোপন ৩ জন শ্রমিকের মজুরি ১২০০, জমিতে এক বস্তা ইউরিয়াসহ অন্যান্য সার ১৩০০, কীটনাশক প্রয়োগ ৪০০, সেচ খরচ (ডিজেল) কার্ত্তিক মাস হতে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৩০ লিটার ২২৫০, সেচ দেয়ার ইঞ্জিন ভাড়া ৮০০, ধান কাটা ৫ জন শ্রমিকের মজুরি ৩৫০০, মাড়াইকলের ভাড়া ৬০০, ধান শুকানো ১ জন শ্রমিকের মজুরি ৭০০, অন্যান্য ১০০০, জমি লিজ নেয়া হলে (এক ফলের জন্য) জমির মালিককে দিতে হয়েছে ৫০০০ টাকা।
জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করলে মোট খরচ হবে ১৮০০০ টাকা; আর যদি জমির মালিক নিজেই আবাদ করেন তবে ব্যয় হবে ১৪০০০ টাকা। এবার ধানের জমিতে চিটা হওয়ায় ধান হবে প্রায় ১৪ মণ; যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রতিমণ ধান ৫০০ টাকা। সে হিসাবে ১৪ মণ ধানের বাজারমূল্য ৭০০০ টাকা। লিজি ১১ হাজার মালিকানা কৃষক ৭০০০ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। লিজি কৃষকের ধানের মূল্য জমিতে পড়বে প্রতিমণ ১২৮৫, মালিকানা কৃষকের ধানের মূল্য জমিতে পড়বে প্রতিমণ ১০০০ টাকা।
এবারের ধানের জমিতে চিটা (চুচা, চেডা) কেন এমন সব প্রশ্নের উত্তরে কৃষকেরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমাদের কাছে কৃষি অফিসার মাঠে নিয়মিত আসেন না। যদি তারা মাঠে আসতেন এবং কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার, বীজধান যাচাই-বাচাই ও সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ কিংবা কখন কি সার জমিতে কি পরিমাণ দিতে হবে তার পরামর্শ প্রদান করতেন তাহলে আমাদের এমন ক্ষতি হতো না।
কৃষি অফিসার মাঠে নিয়মিত না আসার বিষয়টি উপজেলা প্রসাশনকে অবহিত করেছেন কী? উত্তরে তারা জানান, অভিযোগ দিয়ে কোনো লাভ নেই। মাঠে নামে আসা-যাওয়া করে তার ব্লকের ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার এবং মেম্বারের লোকদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করে চলে যান। এমনকি সরকারি অনুদান কৃষিপণ্য প্রকৃত গরীব কৃষকেরা পায় না। সেখানে হয় আত্মীয়করণসহ আছে সবই।
আমাদের কৃষি বিভাগ বা সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হাওরের কৃষকেরা ভালো ফসল ফলাতে পারবেন এবং চাষীরা ন্যায্যমূল্য পাবেন, এ বিষয়ে আপনাদের কোনো মতামত আছে? চাষীরা জানালেন, সর্বপ্রথম কৃষিপণ্য, কৃষি প্রশিক্ষণ নিয়ে দলবাজি বন্ধ ও প্রকৃতি কৃষকদের কাছ থেকে সরকার ধান ক্রয় করতে হবে। আমাদের এলাকার সাধারণ কৃষকেরা এলেসডিতে ধান বিক্রয় করতে পারে না। প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশে প্রতিবছর সরকারি লোকজন তাদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে থাকে। প্রত্যেক কৃষক পরিবার হতে একজন সদস্যকে কৃষির ওপর উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে হাওর অঞ্চলে কৃষকেরা উন্নতি লাভ করতে পারে। নতুবা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সমস্যায় কৃষক দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভূমিহীন হতে পারে।
২৮ব্রি ধানে চিটা পরার বিষয় নিয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার হারুন রশীদের সাথে কথা হলে তিনি জানান, সময়মতো যথেষ্ট পরিমাণ সার জমিতে প্রয়োগ না করায় এমনটি হতে পারে। কৃষি অফিসারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের আনীত অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, এগুলো ভিত্তিহীন কথা। অফিসারগণ নিয়মিত তাদের ব্লকে যান এবং কৃষিকাজে চাষিদের সহায়তা করেন। তবে কেউ যদি অফিসারদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন তবে বিষয়টি আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।