মো: হেলাল উদ্দিন, বিশেষ প্রতিনিধি ।।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার হাওর এলাকার জনমানুষের দীর্ঘদিনের বহুল প্রত্যাশিত নির্মাণাধীন নিকলী-করিমগঞ্জ সংযোগ তথা জেলা সদরে যাতায়াতের রাস্তা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ২০১৭ সালের মে মাসে শুরু হয়। চরম দুর্গম অবহেলিত প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চল নিকলীর মানুষের ভাগ্যের আকাশে আলোর হাতছানি দেয়। পরিবর্তন সাধিত হয় দুর্গম রাস্তায় হেঁটে চলার দিনগুলো এবং দৃশ্যমান হয়ে উঠে নিকলী-করিমগঞ্জ হয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের রাস্তা। নামকরণ করা হয় রাষ্টপতি আব্দুল হামিদ সড়ক।
নিকলী-বাজিতপুরের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আফজাল হোসেন এবং করিমগঞ্জ-তাড়াইলের সংসদ সদস্য মজিবুল হক চুন্নু আনুষ্ঠানিকভাবে স্ব-স্ব অংশে রাস্তার কাজের শুভ সূচনা করেন।
প্রকল্পটির কিছু অংশ বাকি রেখেই সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যায় কার্যক্রম। এ বিষয়ে নিকলী উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রহমান মহিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, “বর্তমান সরকার অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ১০.২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের জন্য ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে। ইতিমধ্যে নিকলী উপজেলার সীমানা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। করিমগঞ্জের গুনধর ইউনিয়নের প্রায় ২ কিলোমিটার রাস্তার কাজ বাকি আছে। যথারীতি কাজ চলছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের এক আদেশে কাজের শেষ পর্যায়ে এসে রাস্তার নির্মাণ কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
গত ১৮ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে আমি সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি উকিল নোটিশ পেয়েছি। এতে দেখা যায়, করিমগঞ্জ উপজেলার খয়রত গ্রামের হালিমা আক্তার স্বামী হাজী আহম্মদ আলী, মুজিবুর রহমান, জহির মিয়া, সোহেল মিয়া, মো: আলম সর্ব পিতা হাজী আহম্মদ আলী, মদন গ্রামের আ: হামিদ পিতা মৃত সাহেব আলী গং ২৪ জন বাদী হয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। বিষয়টি জানার সাথে সাথে আমি জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফ খানকে বিষয়টি অবহিত করি।”
অন্যদিকে করিমগঞ্জ উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার মো: মিজানুর রহমান রাস্তার কাজ বন্ধের ব্যাপারে এ প্রতিনিধিকে জানান, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সড়কটি সোজা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের কিছু জমি রাস্তায় পড়েছে। তাই কিছু সমস্যা হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে কাজ শুরু হবে। রাস্তার নিয়ে কারা মামলা করেছে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলার কোনো কাগজপত্র আমি পাইনি। তবে বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। আশা করি অচিরেই আবার কাজ শুরু হবে।
রাস্তার কাজ বন্ধের ফলে নিকলীর জনমানুষের মাঝে এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। সকল মহলের মানুষের মাঝে বইছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। রাস্তাটি মূলত নিকলী উপজেলাবাসী প্রায় ১লাখ ৯০ হাজার মানুষের প্রয়োজনে নির্মাণ হচ্ছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক সময় প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে নিকলীর মানুষেরা প্রায় ২ ঘণ্টায় কিশোরগঞ্জ যেতে হতো। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সড়কের কাজ সম্পন্ন হলে ৪৫ মিনিটে নিকলী থেকে জেলা সদরে পৌছতে পারবেন। কমে আসবে সময় ও অর্থের অপচয়। কম খরচে কৃষকের গোলায় উঠে হাওরের বোরো ফসল কোটি কোটি টাকার ধান। রাস্তার কাজ বন্ধের সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার দেখা যায়।
নিকলী উপজেলার কারপাশা, দামপাড়া, সিংপুর, নিকলী সদর ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সাথে কথা হলে তারা এ প্রতিনিধিকে জানান, যদি সহসা বিষয়টি সমাধান না হয় তবে আমরা নিকলীবাসী খয়রত এলাকায় মানববন্ধন করব। প্রয়োজনে আন্দোলনের ডাক দেয়া হতে পারে।
রাস্তাটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, খয়রত এলাকায় রাস্তার মধ্যে একটি ব্রিজ নির্মাণ হচ্ছে। আর ব্রিজের পাশে রাস্তার মাঝখানে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তির সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ৫২১১/২০১৯,২৩-০৫-১৯ইং তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মইনুল ইসলাম ও আশরাফ কামালের বেঞ্চের এক আদেশের মাধ্যমে অত্র জমির ওপর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের রাস্তা নির্মাণের কাজে স্থিতাবস্থা জারি করেছেন। উক্ত জমির ওপর আর কোনো নির্মাণ কাজ করা হলে আদালত অবমাননা বলে গণ্য হবে; যা একটি ফৌজদারী অপরাধ।
বিষয়টি নিয়ে করিমগঞ্জ-তাড়াইলের এমপি মজিবুল হক চুন্নু এবং নিকলী-বাজিতপুরের এমপি আলহাজ্ব আফজাল হোসেনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোনে কারো সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
কথা হয় এ রাস্তাটি নিয়ে যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন নিকলীর কৃতিসন্তান সাবেক এলজিআরডি সচিব কারার মাহমুদুল হাসানের সাথে। তিনি বলেন, কারণে রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে আছে তা নিয়ে সরকার ও প্রশাসনের সকল পর্যায়ে আমরা কথা বলেছি। আশা করা যায় অতি সহসাই বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে। এতে নিকলীবাসীর শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কথা হয় এ রাস্তার ঠিকাদার ভৈরব উপজেলার বাসিন্দা সেলিমের সাথে। তিনি বলেন, এ প্রতিবন্ধকতার কারণে রাস্তার কাজের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বৃষ্টিতে মাটি ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। এত দিনে রাস্তাটি আমি এলজিইডির কাছে হস্তান্তর করতে পারতাম। অনেক টাকার সিমেন্ট নষ্ট হচ্ছে, নিয়ে গেছে অনেক টাকার রড। এ অবস্থায় আমি কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। আমার মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাবো।
খয়রত ও মদন গ্রামের ভুক্তভোগী কৃষকদের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমাদের মধ্যে কেউ ৩৫ শতাংশ জমির মালিক, কেউ ৭০ শতাংশ। আবার কেউ ২০ শতাংশ জমির মালিক। এমন অনেক কৃষকের সমুদয় জমি রাস্তায় চলে গেছে। এ সমস্ত কৃষক পরিবার কিভাবে জীবন ধারণ করবে! তাই সরকারের কাছে জমির ক্ষতিপূরণ দাবি করছি, সরকার যাতে আমাদের ভূমির ন্যায্যমূল্য আমদেরকে প্রদান করে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, গ্রাম দু’টিতে একটি কুচক্রি মহল রয়েছে। তারা চায় না রাস্তাটি নির্মাণাধীন জায়গার ওপর দিয়ে হোক। এলাকাবাসী বলেন, মহলটি সাধারণ মানুষদের রাস্তার ওপর প্রতিকুলতা সৃষ্টির জন্য উৎসাহ প্রদান করে যাচ্ছে।