বিভিন্ন কারণে শিশুর ইউরোলজিক্যাল সমস্যা হয়। সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা না করা হলে সমস্যাগুলো জটিল হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা এম কবিরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : কী কী সমস্যাকে আমরা ইউরোলজিক্যাল সমস্যা বলব?
উত্তর : আমরা যেটা সাধারণত পাই, কিডনিতে হতে পারে সমস্যা। কিডনি থেকে নিচে যদি আসেন, ব্লাডারে সমস্যা হতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে পেনিসে হতে পারে। মেয়েদেরও ভ্যাজাইনাতে সমস্যা হতে পারে।
কিডনিতে রক্ত ছেঁকে প্রস্রাব তৈরি হয়। ওই প্রস্রাবটা ছেঁকে এসে ব্লাডারে জমা হয়। প্রস্রাবের থলিতে জমে। ওখানে অনেক সময় বাধা হতে পারে। বাধা হলে, যে প্রস্রাবটা তৈরি হচ্ছে সেটি কিডনিতে জমবে। এতে আস্তে আস্তে কিডনিটা বড় হয়ে যায়।
এরপর ইউরিটরেও কোনো জায়গায় বাঁকা থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো জিনিসটি জন্মগতভাবে তৈরিই হয় নাই। অনেক সময় ভিতরে পর্দা থাকতে পারে।
তারপর ব্লাডারে আসেন। অনেক সময় দেখা যায় ব্লাডার কাজই করছে না। ব্লাডারে কোনো টিউমার হতে পারে। ব্লাডারে বাধা থাকতে পারে। ছেলেদের বেলায় অনেক সময় পেনিসে সমস্যা হতে পারে। পেনিসের রাস্তা হয়তো সামনে থাকার কথা, কখনো পেছনে থাকে। প্রস্রাবের রাস্তার যেই মুখটি রয়েছে সেটিও অনেক সময় সরু থাকে। এসবেরই কিন্তু চিকিৎসা রয়েছে। আপনি যদি চিকিৎসা নিতে দেরি করেন সবগুলোরই সমস্যা হবে।
যেমন, আপনার কিডনিটি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। দেরি করলে এটি আস্তে আস্তে ফুলতে থাকে। এগুলোর ক্ষেত্রে যত আগে আসবেন তত ভালো। কিডনিতে একটি মাংস আছে, সেটি যদি পাতলা হয়ে যায় ওটাকে ঠিক করা কঠিন।
এখন হয়তো প্রস্রাবের রাস্তার নিচে সমস্যা আছে। এটি নিয়ে হয়তো চিকিৎসকদের কাছে গেল। চিকিৎসক বলল, ‘বাচ্চা বড় হোক’। তবে যদি পাঁচ থেকে সাত বছর পড়ে আসে তখন ঠিক করা কঠিন। যত বড় হচ্ছে তার মানসিক বৃদ্ধি কিন্তু হচ্ছে। সাত আট বছরের বাচ্চা কিন্তু মানসিকভাবে খুব পরিপক্ব। সে তার সমস্যা বুঝতে পারে। তাই আমরা বলি, যেই অস্ত্রোপচারই হোক সেটি স্কুলে যাওয়ার আগে করা ভালো। কারণ স্কুলে গিয়ে অনেক বন্ধুর সাথে মেলামেশা করে। তখন বুঝতে পারে আমার এই জিনিসটির সমস্যা আছে।
অনেক ক্ষেত্রে ভুল পরামর্শ দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘আরেকটু পরে অস্ত্রোপচার কর।’ এ বিষয়ে কিছু বলেন?
হ্যাঁ, সেটাই আমি বলছি। সবসময় দেরি করে। পরিবারের লোকজন আছে, অনেক চিকিৎসক আছে, যারা আবার ভুল তথ্য দেয়। আশপাশের লোকজন বলে, ‘এত ছোট বাচ্চা অস্ত্রোপচার করাবে?’ যেকোনো সমস্যাই হোক না কেন ইউরোলজিক্যাল সেটার জন্য তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করে নেওয়া ভালো।
যেমন ধরেন মুসলমানির একটি বিষয় রয়েছে। সেটা খুব প্রচলিত জিনিস। অনেকে জন্মের এক দুই মাস পরই বাচ্চাকে নিয়ে আসে, মুসলমানি করাতে। তখন আমরা নিষেধ করি, ‘এখন না।’ তো দেখা গেল, অনেকে আমার কথা বিশ্বাস করে না। অন্য জায়গায় গিয়ে করায়। তবে পড়ে আবার জটিলতা নিয়ে আসে। সবচেয়ে বড় জটিলতা হয় মুসলমানি করার পর প্রস্রাবের যেই রাস্তাটি রয়েছে সেটি সরু হয়ে যেতে পারে। ওখানে সংক্রমণ হয়। কারণ, আগে কেউ বাচ্চাকে ডায়াপার বা প্যামপার্স পরাত না। এখন কিন্তু গ্রামেগঞ্জে এগুলো আছে।
মুসলমানি করানোর পর ডায়াপার পরালে বাচ্চা কখন প্রস্রাব ও পায়খানা করল জানা যাচ্ছে না। এতে ওখানে সংক্রমণ হবে। অস্বস্তি হবে। প্রস্রাবের রাস্তা চিকন হয়ে যাবে।
মুসলমানির জন্য সঠিক সময় কখন?
মুসলমানির জন্য সঠিক সময় হলো স্কুলে যাওয়ার আগে। তিন থেকে চার বছরের মধ্যে। যখন সে ডায়াপার ছেড়ে দেবে। তখনই করিয়ে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। আর পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের চিকিৎসকদের একটি দল একমত হয়েছেন, এই সময়ের আগে করলে প্রস্রাবের রাস্তা সরু হয়ে যেতে পারে।
ইউরোলজিক্যাল সমস্যাগুলো সবসময় দৃশ্যমান হবে? না কি কোনো লক্ষণের মাধ্যমে বুঝতে পারব?
না, না, এটা সবসময় দৃশ্যমান খুব কম হয়। কিছু কিছু লক্ষণ হবে। যেমন ধরেন কিডনিটা খুব বড় হয়ে যাচ্ছে। হয়তো দেখা যাচ্ছে তার প্রস্রাবে বারবার ইনফেকশন হচ্ছে, তখন বলা হয় দুইবারের বেশি যদি সংক্রমণ হয় পুরোপুরি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার জন্য।
তখন যদি আল্ট্রাসোনোগ্রাম করি, হয়তো দেখা গেল কিডনি বড় আছে। আরো কিছু পরীক্ষা রয়েছে। আমরা সেগুলো করি।
আর কিছু লক্ষণ হয়তো জন্মের পরই দেখা যাচ্ছে। তখন অনেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসে। আবার অনেকে বলে আমার বাচ্চার ‘পয়গম্বরি মুলমানি’ হয়ে গেছে। যখন এ কথা বলে আমরা বুঝি বাচ্চার কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে।
সেক্ষেত্রে কী বাচ্চার নড়াচড়ার কোনো পরিবর্তন আসবে?
নড়াচড়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। হয়তো কিডনিতে টিউমার হতে পারে। ওটা অনেক বড় হয়ে গেল। তখন হয়তো মা শরীরে হাত দিয়ে বুঝতে পারবে সমস্যা হচ্ছে।
এই ত্রুটিগুলো কী শিশুটির জন্মের আগে বোঝার কোনো উপায় রয়েছে?
জন্মের আগে কিছু কিছু রোগ আছে। সেটি আপনি বুঝতে পারবেন। যেমন কিডনি বড় হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বিশেষজ্ঞরা আগে থেকে বলে দিতে পারেন। কিডনির আকারটা বলে দিতে পারেন। অনেক সময় মুত্রথলিটা বের হয়ে আসে, খোলা থাকে।
এই সমস্যাগুলো কেন হয়?
আসলে আজ পর্যন্ত এর সঠিক কারণ জানা যায়নি। জানা থাকলে এই রোগগুলো হতো না। আগে বিভিন্ন ওষুধ খেলে বাচ্চাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গঠন হতো না। ওগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর এগুলো কমে গেছে। তবে এগুলো হলো অনেক জিনিস মিলে হয়। যেমন, এরমধ্যে মায়ের পুষ্টির বিষয়টি রয়েছে। মায়ের কোনো রোগ হচ্ছে কি না। তার পরিবেশগত বিষয়ে কোনো সমস্যা আছে কি না- এগুলো মিলে সমস্যাগুলো হতে পারে।
এই ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক কোনো ব্যবস্থা কী আমরা নিতে পারি?
প্রতিরোধ বিষয়টি আসলে এখানে খুব কঠিন। মূল বিষয় হলো মায়ের পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মাকে ভিটামিন, আয়রন, ফলিক এসিড এগুলো খেতে হবে। আর মা কে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে চেকআপে থাকতে হবে।
আলাপচারিতার পূর্ণাঙ্গ ভিডিও লিংক
সূত্র : এনটিভি অনলাইনে প্রকাশিত