মো: আল আমিন, বিশেষ প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ)
দীর্ঘ ১৯ বছর পর কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হচ্ছে শুক্রবার ১৯ ফেব্রুয়ারি। কিশোরগঞ্জ পুরাতন স্টেডিয়ামে দুপুর দুইটায় শুরু হবে এ সম্মেলন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নিজ জেলার এ সম্মেলকে ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
তবে সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচিত না হয়ে মনোনীতরাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ পাচ্ছেন। এমন গুঞ্জন বাতাসে ভাসছে। এ বিষয়টি নিয়ে দল অনেকটা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ১৯৯৭ সালে সর্বশেষ কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। সে সময়ও ভোটাভুটিতে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়নি। তখন সভাপতি পদ পেয়েছিলেন বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। আর সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন প্রয়াত সংসদ সদস্য একেএম শামছুল হক গোলাপ।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের ইতিহাসে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদই সভাপতি হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগ চালিয়েছেন সবচেয়ে বেশি সময়। তিনি স্পিকার হওয়ার পর দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি নেন। তার পরও দল পরিচালনায় তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যা এখনো বিদ্যমান। তিনি হাওর অধ্যুষিত মিঠামইনের বাসিন্দা। হাওরের তিনি উপজেলা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম নিয়ে ছিল তার নির্বাচনী এলাকা। বর্তমানে তার আসনে সংসদ সদস্য হয়েছেন ছেলে তৌফিক।
জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, এবারের সম্মেলনে সভাপতি বা অন্য কোনো পদ নিয়ে কথাবার্তা কম থাকলেও সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে শহরে আলোচনা তুঙ্গে, আছে উত্তেজনাও। এর কারণ, একদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বড় ছেলে সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহম্মদ তৌফিক, অন্যদিকে একই পদে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচাতো ভাই সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। এ দুই পরিবারের বাইরে আওয়ামী লীগ নেতা শরীফ আহমেদ সাদীও সাধারণ সম্পাদক হতে চান। শেষের জন অনেকটা নীরব থাকলেও রাষ্ট্রপতির ছেলে ও সৈয়দ আশরাফের ভাইয়ের সমর্থকেরা এ পদটি পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে আছেন। শহরে অন্য কোনো প্রার্থীর ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন না থাকলেও ‘রেজওয়ান আহম্মদ তৌফিককে সাধারণ সম্পাদক পদে দেখতে চাই’, ‘অন্য কিছু বুঝি না টিটু ভাইকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চাই’ লেখা পোস্টার-ব্যানারে গোটা শহর ছেয়ে গেছে। ফেসবুকেও চলছে প্রচার প্রচারণা। দুই সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী সম্মেলনের দিন শহরে ব্যাপক শো-ডাউন করার পরিকল্পনাও করছেন।
সম্মেলনে সভাপতি পদের দাবিদাররা হচ্ছেন, জেলা পরিষদের প্রশাসক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজল, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ আজিজুল হক।
কাউন্সিলরদের ভোটাভুটি এড়িয়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের গুঞ্জন নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, কমিটি গঠন গণতান্ত্রিকভাবেই হওয়া উচিৎ। কারো মতে, নেতৃত্বের প্রশ্নে ভোটাভুটি অনেক সময় ভালো ফল বয়ে আনে না।
জেলা আওয়ামী লীগ বুধবার রাতে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সম্মেলনস্থল পুরাতন স্টেডিয়ামের ভেতরে দলীয় স্লোগান ছাড়া কেউ ব্যক্তিগত স্লোগান দিতে পারবে না। কেউ কোনো ব্যক্তিগত ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার বহন করতে পারবে না। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান আজ বৃহস্পতিবার এ সিদ্ধান্তের কথা দুপুরে সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
নতুন কমিটি গঠন বিষয়ে আওয়ামীলীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধিকে জানান, সম্মেলনে ভোটাভুটি হোক বা না হোক ‘নাটাই’ মূলত সৈয়দ আশরাফের হাতেই থাকবে। জেলা আওয়ামী লীগকে যারাই চাঙ্গা করতে পারবেন তাদেরকেই তিনি নেতৃত্বে আনবেন। নেতা নির্বাচনে সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেশি চিন্তিত না হতেও নাকি বলেছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমএ আফজল প্রবীণ ও নবীনের মিশেলে ভারসাম্যপূর্ণ কমিটি হবে বলে এ প্রতিবেদককে ধারণা দেন।
দলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এমনও হতে পারে রাষ্ট্রপতি ও জনপ্রশাসনমন্ত্রীর পরিবারের কেউ মূল পদ না-ও পেতে পারেন। এক্ষেত্রে দুই পরিবারের বাইরে কিন্তু দুই বলয়ের সমর্থক- এমন নেতাদের বেছে নেয়া হতে পারে মূল দুটি পদের জন্য।
নেতৃত্ব নির্বাচনে কাউন্সিলরদের ভোটাভুটি না হওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১৩ উপজেলার তিনটি উপজেলা ছাড়া কোথাও পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। ওইসব কমিটির অনেক সদস্য মারা গেছেন। মূলত বহু বছর আগের কাউন্সিলররাই এ সম্মেলনে অংশ নেবেন। তাদের অনেককেই নতুন প্রজন্মের নেতাকর্মীরা চেনেন না। এ কারণে ভোটাভুটি ছাড়াই নেতা নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বর্তমানে সভাপতি পদপ্রার্থী শাহ আজিজুল হক কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে বলেন, কাউন্সিলরদের মতামত না নিয়ে কমিটি হলে দলের ক্ষতি হবে।
তরুণরা মনে করেন, দল ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রবীণ নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন সরকারি পদ-পদবিও পেয়েছেন। দল গোছানের চেয়ে তারা এতদিন ওইসব কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। কাজেই তাদের এবার পরামর্শকের ভূমিকায় চলে যাওয়ার সময় এসেছে।
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এনায়েত করিম অমি বলেন, ২০ বছর আগে ছাত্র রাজনীতি করেছি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় মূল দলে ঢুকতেই পারলাম না। আমাদের মতো ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতারা আজ পর্যন্ত মূল দলের কোনো পদ-পদবি পাননি। আশা করছি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এবার তরুণদের সেই আক্ষেপ দূর হবে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সম্মেলনের ভেন্যু পুরাতন স্টেডিয়ামে বিশাল নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। সেখানে শেষ মুহূর্তের কাজকর্ম চলছে। আয়োজকরা জানিয়েছেন, সম্মেলনে ৫০ হাজার নেতাকর্মীর সমাগম হতে পারে। তবে কারো কারো মতে, লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে এ সংখ্যা।
সম্মেলনে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেন, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম ও আওয়ামীলীগের উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।