আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
কিশোরগঞ্জ শহরবাসীর কাছে দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। একের পর এক মাস্তানি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং খুনখারাবির মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ভয়ংকর অপরাধমূলক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে গ্যাংয়ের সদস্যরা।
শহরের বিভিন্ন কর্নারে গড়ে ওঠা গ্যাংয়ের সদস্যরা ইতিমধ্যে তিনটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাদের ২০ থেকে ২৫ মিনিটের তাণ্ডবে কেঁপে উঠে শহরবাসী। শহরের বড়বাজার তেরিপট্টি এলাকায় কলেজছাত্র রাজা হত্যাকাণ্ডে অনেকে সরাসরি অংশ নেয়। ঈশা খাঁ রোডে যুবলীগ নেতা ইউসুফ মণি এবং পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট এলাকার ব্যবসায়ী সাগরকে তারা খুন করে।
কথিত বড়ভাইদের সঙ্গে এবং নির্দেশে তারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায়। জানা গেছে, নেশার জগতে ঢুকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কারণে-অকারণে ভয়ংকর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালায়। এসব করে তারা উল্লাসও প্রকাশ করে। এতে সাধারণ মানুষ ভয় পেলে তাদের আনন্দ ও উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। হত্যা মামলায় গ্রেফতার কিশোর গ্যাং লিডার সামাউল হক নিলয় (১৯) সম্প্রতি আদালত ও পুলিশের কাছে এ ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শহরের বিভিন্ন কর্নারে কিশোর অপরাধীদের ১০ থেকে ১১টি গ্যাং আছে। প্রতিটি গ্যাংয়ে ৭০ থেকে শতাধিক সদস্য রয়েছে। তাদের অধিকাংশই কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়, আজিমুদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়, হাসমত উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়, আরজত আতরজান উচ্চবিদ্যালয়, সরকারি গুরুদয়াল কলেজ এবং ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজের ছাত্র। তাদের অনেকে আবার স্কুল ও কলেজের ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। গ্যাংয়ে বেকার ও শ্রমজীবী কিশোরও রয়েছে।
অপরাধ করেও এসব কিশোর গ্যাংয়ের অধিকাংশ লিডার ও সদস্য এখনও অধরা। কোনো কোনো গ্যাং স্বাধীনভাবে চলে। আবার কোনো কোনো গ্যাং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কথিত বড়ভাইদের ছত্রছায়া ও নিয়ন্ত্রণে চলে। আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের মহড়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থায় অংশ নিয়ে থাকে।
২০১৮ সালের প্রথমদিকে প্রথম সংঘবদ্ধভাবে রাস্তায় নামে ওইসব দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং। হঠাৎ কেঁপে উঠে কিশোরগঞ্জ শহর। মুখোশধারী সশস্ত্র কিশোর সন্ত্রাসীরা হকিস্টিক, চাপাতি, রামদা, ছুরি-লাঠি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। বাসাবাড়ি-দোকানপাট ভাংচুর করার পাশাপাশি তারা পথচারীদেরও কুপিয়ে জখম করে। শহরজুড়ে একের পর এক তাদের তাণ্ডব চলে। ২০ থেকে ২৫ মিনিটের তাণ্ডবে কেঁপে ওঠে শহরবাসী। পুলিশ আসার আগেই তারা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। তাদের উপর্যুপরি হামলায় তিনজন প্রাণ হারানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ ডজনখানেক পথচারী গুরুতর জখম হয়েছে। শহরের নগুয়া, ভিন্নগাঁও, বত্রিশ, বড়বাজার, তেড়িপট্টি, রথখোলা, ঈশা খাঁ রোড, গৌরাঙ্গবাজার, পুরান থানা, শোলাকিয়া, খরমপট্টি, কুটিগির্দী, পুরাতন স্টেডিয়াম প্রভৃতি এলাকার দোকানপাট ও আবাসিক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের বর্বরোচিত হামলা ও ভাংচুরের ক্ষত এখনও রয়েছে। কেবল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই নয়, গ্যাংটি জড়িত ছিল কিলিং মিশনেও।
২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল নিলয়ের নেতৃত্বে শহরের বড়বাজার তেড়িপট্টি এলাকায় হামলা চালানো হয়। এতে কলেজছাত্র রাজা প্রাণ হারায়। দীর্ঘদিন ধরে ওতপেতে থেকে পুলিশ একটি গ্যাংয়ের লিডার নিলয়কে গ্রেফতার করে। ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঈদগাহ রোড (রেলক্রসিং) থেকে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র নিলয়কে গ্রেফতার করা হয়। তাকে গ্রেফতারের পরই বেরিয়ে আসে ভয়ংকর ও লোমহর্ষক চাঞ্চল্যকর তথ্য। নীলগঞ্জ মোড়ের মো. কাজল মিয়ার ছেলে নিলয়কে দুই দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। নিলয় পুলিশকে জানায়, তার গ্যাংয়ে সমবয়সী শতাধিক কিশোর আছে। তারা নেশাগ্রস্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি হামলা ও ভাংচুর চালায়। এ হামলার সময় মানুষ ভয় পেলে তাদের আনন্দ ও উৎসাহ বেড়ে যায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই তারা ভয়ংকর অ্যাকশনে যায়। কখনও গ্যাংয়ের কোনো সদস্যের সঙ্গে কারও ঝগড়াঝাটি হলেও সংঘবদ্ধভাবে প্রতিপক্ষের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সিসি ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ দেখেছে- বড়বাজার তেড়িপট্টি মোড়ে কলেজছাত্র রাজাকে মুখোশ পরা ১৬ থেকে ১৭ জন কিশোর আনন্দের সঙ্গে কোপাচ্ছে। রাজা হত্যার পর তাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। তারা আরও বেপরোয়া রূপ ধারণ করে। কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার তৎকালীন ওসি আবু শামা মো. ইকবাল হায়াত জানান, সন্ত্রাস নির্মূল ও কিশোর অপরাধীদের ধরতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। একাধিক অভিযান পরিচালনা করে নিলয়ের সহযোগী সানি, পিয়াস, সোহাগসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজা হত্যা মামলায় তারা এখন জেলহাজতে আছে।
শহরের বহুল আলোচিত ইউসুফ মণি হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর মডেল থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) মোহাম্মদ জাকির হোসেন জানান, যুবকদের সঙ্গে চিহ্নিত কিশোর গ্যাং লিডার কলেজছাত্র ইমন খানসহ বেশ কয়েকজন কিশোর হামলায় অংশ নেয়। নির্মাণকাজে চাঁদা আদায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় যুবলীগকর্মী ইউসুফ মণিকে হত্যা করা হয়। শহরের ব্যস্ততম ঈশা খাঁ রোডের মাধবী প্লাজার সামনে ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি রাতে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মণিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ সময় মণির ভাই পৌর কাউন্সিলর ইয়াকুব মণি গুরুতর আহত হন।
ব্যবসায়ী সাগর হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সদর মডেল থানায় ওসি (তদন্ত) মো. মিজানুর রহমান জাহান বলেন, এ হত্যা মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২১ জনই কিশোর। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর।
২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল তুচ্ছ ঘটনার জেরে জজকোর্ট সংলগ্ন পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রবেশপথে ব্যবসায়ী সাগরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই জেনারেল হাসপাতালের সামনে থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য জসিম উদ্দিনকে (মেম্বার) চোখ-মুখ বেঁধে অপহরণ করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের নীলগঞ্জ এলাকায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে তাকে আটকে রাখে। এরপর তার কাছ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা ও মোবাইল ফোন সেট কেড়ে নিয়ে এবং মারধর করে মুক্তিপণ দাবি করে। বিকাশ নম্বরে ২০ হাজার টাকা পাঠানোর পর জসিম মেম্বারকে মুক্তি দেয়া হয়। মামলার কাজে জজকোর্টে যাওয়ার পথে তিনি এ চক্রের খপ্পরে পড়েন। এ ঘটনায় তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এমদাদুল হক সজলকে (২২) মুক্তিপণ বাবদ নেয়া ২০ হাজার টাকাসহ আটক করে।
২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার নারায়ণপুর সিংরইল গ্রামের গোলাম মোস্তাফার ছেলে সাদ্দাম কেনাকাটা করতে এসে শহরের খরমপট্টি এলাকা থেকে অপহৃত হয়। একই অটোরিকশায় যাত্রী বেশে উঠে তিন কিশোর তাকে অপহরণ করে। অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। একই দিন সন্ধ্যায় অপহৃতের বাবা কিশোরগঞ্জ র্যাব ক্যাম্পে অভিযোগ করেন। র্যাব-১৪ অভিযান চালিয়ে খরমপট্টি এলাকা থেকে কিশোর দীপ্ত বসাককে আটক করে এবং তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সাদ্দামকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সদর মডেল থানায় কিশোর শিশির, অজয় ও দীপ্তকে আসামি করে মামলা করা হয়।
র্যাব-১৪ এর কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের অধিনায়ক শোভন খান জানান, এ শহরে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ছিনতাই ও অপহরণ থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত অনেককে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, কিশোররা নেশার টাকার জন্য ভয়ংকর সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। নেশার টাকার জন্য মা-বাবা ও বড় ভাইকে মারধরের অপরাধে মো. বক্কর (১৯) নামে এক কিশোরকে দেড় বছরের কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ২০১৯ সালের ১৪ আগস্ট ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক কিশোরগঞ্জ কালেক্টরেটের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মীর মো. আল কামাহ তমাল এ দণ্ড দেন। এর আগে তাকে চুকিনগর গ্রাম থেকে আটক করা হয়। সাজাপ্রাপ্ত বক্কর সদর উপজেলার চৌদ্দশত ইউনিয়নের চুকিনগর গ্রামের হাজী আবদুল খালেক সরকারের ছেলে। কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, মাদকের প্রভাব আর অসৎসঙ্গ কিশোরদের বিপদগ্রস্ত করছে। কিশোরগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সদ্যবিদায়ী প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল্লাহ বলেন, অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতা এবং অসৎ সঙ্গে কিশোররা বিপথে যাচ্ছে। বিভিন্ন অসামাজিক কাজে তারা জড়িয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের বেশি দায়িত্ব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। কিশোরগঞ্জের ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কলা ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন এবং কিশোরগঞ্জ সরকারি গুরুদয়াল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল প্রফেসর মোহাম্মদ আরজ আলী বলেন, দিন দিন একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ায় কিশোররা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
সূত্র : যুগান্তর