বৃদ্ধাশ্রম
এস এম ইলিয়াস
তিল তিল করে আশি ছুঁই ছুঁই, কত পথ দিয়ে পাড়ি
কত যে আপন পর হয়েছে, কতজন গেছে ছাড়ি।
কত স্বজনে ভরপুর ছিলো, সকাল-সন্ধ্যা-রাতি,
সকলই হারিয়ে একাকী আজ, নিরবতা প্রিয় সাথী।
সেই যে কবে ভাসায়েছি তরী, এই না জীবন নদে
কত যে বেয়েছি জীবন তরী পৌছতে জনপদে।
পাড়ি দিয়েছি অকুল পাথার, পাইনি কুলের দেখা
সব হারায়ে অবশেষে আজ হয়ে গেছি বড় একা।
চারিদিক কত মুখরিত ছিল, ছিল সঙ্গী সাথী ভাই
স্বার্থের তরে কিছুকাল পরে আজ তারা কেহ নাই।
জীবিকার তরে ব্যস্ত সবে আজ কে কোথায় আছে
সেই সোনালী দিনগুলো খুঁজে পাওয়া আজ মিছে।
কত যে ছিল সোনালী বিকেল হারিয়ে গেছে আজ
পাখির বাসায় ছানার খোঁজে কত যে বেয়েছি গাছ
পুকুর পাড়ের বড় গাছ থেকে দিয়েছি কত ঝাঁপ
হেসে খেলেই পার হতো দিন, ছিলো না কোনো চাপ।
স্কুল পালিয়ে যেতাম ছুটে খেলার মাঠের পথে
উঠতো জমে খেলার আসর সব সাথীদের সাথে।
পাড়ার সকল ছেলেদের নিয়ে হতো ক্রিকেট খেলা
ফুটবল ও লাটিম-মারবেলে পার হয়ে যেত বেলা।
বর্ষার জলে ডুবে থাকতাম সারাটা দুপুর ভর,
সাপ-বিচ্ছু কোনো কিছুর ছিলো না কোনো ডর।
দল বেঁধে সবে মাছ ধরতাম হাওরের মিঠা জলে
যাওয়ার সময় হাত ভরতাম শালুক শাপলা ফুলে।
সারাটা গাঁ মাতিয়ে রাখতাম আমরা ক’জন মিলে
এমন করে সোনালী শৈশব ধীরে ধীরে গেল চলে।
স্কুল-কলেজের ডিঙি পেরিয়ে ভার্সিটিতে এসে
শৈশবের সেই সাথীদের কথা ভাবতাম বসে বসে।
কেউ কেউ নাকি কাজ ধরেছে, কেউ পড়েছে ঝরে
সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে সব চলে গেছে দূরে।
মন খারাপের এমন সময় সাথী পেলাম এক খুঁজে
হাতটি ধরে সারাটি জনম থাকবে দু’চোখ বুঁজে।
হাজার রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে আমারে আপন করি
কথা দিয়েছিলো এই আমারে কভু যাবে না ছাড়ি।
মায়াবী তাহার মুখখানি যেন স্বপ্নে দেখা পরী,
স্বপ্নের ডানায় ভর করিয়া তারে নিয়া দেই পাড়ি।
তারপরে আসি কর্মজীবনে তাহারে করিয়া সাথী
আধার ঘরে সে যেন আমার ছিলো জ্যোৎস্নার বাতি।
সারা দিনমান কর্ম শেষে যবে দেখতাম তার মুখ
ক্লান্তি-শ্রান্তি মুছে যেত সব জুড়িয়ে যেত বুক।
এমন করিয়া কাটিতে লাগিল দিন-মাস ও বছর
হঠাৎ করিয়া নামিয়া আসিল অভিমানী এক ঝড়।
আঁধার এ ঘর আলোকিত করে জ্বলল এক বাতি
পুত্রসন্তান দান করে তার নিভিলো জীবন বাতি।
আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায় এখন কি আর করা
দুনিয়ায় এসেই মাকে খেলি হায়রে কপাল পোড়া।
ভালোবাসার স্মৃতি তারে নিলাম কোলে তুলে
তার দায়িত্বে নেমে পড়লাম সকল কিছু ভুলে।
আমিই তার বাবা হলাম আমিই হলাম তার মা
মা হারানোর ব্যথা তারে কভু বুঝতে দিলাম না।
তিল তিল করে গড়ে তুলি তারে মনের মত করে
যায় না যেন মানিক আমার এই আমারে ছেড়ে।
মা হারা ছেলে বলিনি কিছু, যদি সে কষ্ট পায়
সেই সুযোগে কত না কিছু করেছে ডানে বাঁয়।
এখন ছেলে আমার ধীরে ধীরে অনেক বড় হয়ে
বিয়ে করে এক বউ আনিল বড় লোকের মেয়ে।
যার জন্য জীবন যৌবন সকলই দিলাম ছাড়
কেমন করিয়া হয়ে গেল সে এতটা স্বার্থপর।
আমারে ছাড়া একটা সময় বুঝিত না কোনো কিছু
কোথাও যদি যাইতে চাইতাম ছুটিত পিছু পিছু।
আজ আমার বয়স হয়েছে, হয়ে গেছি আমি বুড়া
সবকিছুই তার দিব্যি চলছে এই আমারে ছাড়া।
কেমন করে দূরে সরে গেল মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে
হয়ে গেছি আজ ভীষণ একা আমি হাজার ভীড়ে।
তারপর এই শূন্য জীবনে কত যে গেল ধকল
যেখানে যত আপন ছিল পর হয়ে গেল সকল।
শূন্যতা আজ বড় যে আপন, এইতো আছি বেশ
অপেক্ষায় শুধু দিন গুনি আজ কবে হবে এর শেষ।
চশমা-লাঠি-চেয়ার-ডায়রি বড় প্রিয় সাথী আজ
চুলগুলো সব সাদা হয়েছে, কপালে পড়েছে ভাঁজ
ঘুমহীনতায় কেটে যায় আজ আমার প্রতিটি রাত
অশ্রুজলের সায়রে ভেসে, কপালে রাখিয়া হাত।
প্রিয়জন আমি হইনি কভু, ছিলাম যে প্রয়োজন
আহারে জীবন পার করিলাম, কত যে বিসর্জন।
তবুও যদি সুখী হয় সবে, সার্থক আমার জনম,
বাড়ি-গাড়ি সব থাকতেও, আজ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম।
হৃদয় শত ব্যথিত থাকলেও জীবন চাকা চলে,
বুকের জমানো কষ্টগুলো লুকিয়ে হাসির ছলে।
হৃদয় মাঝে কান পেতে শুনি বড় সকরুণ সুর
এই জীবনের পরিসমাপ্তি ভাবিতেছি কত দূর।
এস এম ইলিয়াস : ছাত্র, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থ বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকাস্থ নিকলী ছাত্রপরিষদ।