নিকলীর কৃতিমুখ কবি মহিবুর রহিম

নিকলী তথা ভাটি অঞ্চলের কৃতিমুখ তিনি। একজন প্রতিভাধর কবি ও স্বনামখ্যাত শিক্ষক। শিক্ষকতা এবং লেখালেখি দুটোই শুরু করেছিলেন নিকলী থেকে। ভাটি অঞ্চলের উদার প্রকৃতি, হাওর, নদী, কর্মজীবী মানুষ তার কবিতা ও সাহিত্যের প্রেরণা। হাওর অঞ্চল তথা ভাটি অঞ্চলকে আধুনিক শিল্পমানসম্পন্ন কবিতার ফ্রেমে ধারণ করেছেন তিনি। নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজের বাংলা প্রভাষক হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। তার নাম মহিবুর রহিম। তিনি নব্বই দশকের অন্যতম একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবে গণ্য। তার জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৫ জানুয়ারি নিকলী উপজেলার প্রত্যন্ত ছাতিরচর গ্রামে। পিতা মরহুম আমজাদ হোসেন ছিলেন সমাজসচেতন রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সংগঠক। মাতা মরহুমা কমলা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিনী। মহিবুর রহিম প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন ছাতিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুল জীবনে সকল পরীক্ষায় প্রথম স্থান তার জন্যে ছিল প্রায় নির্ধারিত। সে জন্যে শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন গভীরভাবে। তার শিক্ষকদের অনেকেই ছিলেন সাহিত্যমনা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পাকুন্দিয়ার কৃতিসন্তান এ কে এম ইমাম উদ্দিন আহাম্মদ, ছাতিরচর গ্রামের মো. নূরুজ্জামান, কাজী নূরুল ইসলাম, মো. ইউনুছ স্যার ও চাঁদপুরের মওলানা রফিকুল ইসলাম। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে ইমামউদ্দিন স্যারের সহায়তায় মহিবুর রহিম ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে। থাকতেন ছাত্র হোস্টেলে। তখন পুরান থানা এলাকায় নানার বইয়ের দোকান নামে পরিচিত একটি দোকান ছিল। মহিবুর রহিমের বই পড়ার সূচনা হয় এই দোকানের মালিক নানার সহায়তায়। কিশোরগঞ্জে মহিবুর রহিম দুই বছর অধ্যয়ন করেন এবং পরবর্তীতে পারিবারিক কারণে এসএসসি পাস করেছেন সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। লেখালেখিও শুরু করেন সেই স্কুল জীবন থেকেই। সে সময়ে কিছু লিটল ম্যাগাজিনে তার লেখা প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে সরারচর থেকে প্রকাশিত ও ইশারফ হোসেন সম্পাদিত ‘সকাল’, কিশোরগঞ্জ শহর থেকে রেজাউল করীম বাবুল সম্পাদিত ‘ঈণ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কিশোরগঞ্জের সাহিত্য আন্দোলনগুলো মহিবুর রহিমকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষত আবিদ আজাদ, আশুতোষ ভৌমিক, জাহাঙ্গীর আলম জাহান ও বাঁধন রায় প্রমুখের লেখালেখি মহিবুর রহিমকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। তাছাড়া ইশারফ হোসেন, হাকিম আরিফ, মানিকুজ্জামান মনির, বদরুজ্জামান আলমগীর প্রমুখের সান্নিধ্য মহিবুর রহিমকে সাহিত্যাঙ্গনে অধিষ্ঠিত করে। মূলত বই পড়া আন্দোলনের মাধ্যমে তার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। ১৯৮২ সালে নিজ গ্রামে তিনি বই পড়া আন্দোলন শুরু করেন এবং স্থানীয়ভাবে একটি পাঠাগার গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাথে যুক্ত হয়ে হান্নান গ্রন্থ সুহৃদ সমিতি গঠন করেন ও দীর্ঘদিন এ আন্দোলন চালিয়ে যান। এ সময়ে রেডিও বাংলাদেশে প্রচারিত ও ড. রাজিব হুমায়ুন উপস্থাপিত ‘কথাকলি’ অনুষ্ঠানে মহিবুর রহিমের কবিতা পঠিত হয়। পরবর্তীতে ভৈরব হাজী আসমত কলেজ, বাজিতপুর ডিগ্রি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে মহিবুর রহিম দেশের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য সংকলনে লেখালেখি শুরু করেন। ভৈরবে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী শরীফ আহমদ, কবি আজিজ হাসান, কবি সুমন রহমান. কামরুজ্জামান কাজল, জিয়া রহমান প্রমুখের সান্নিধ্য তাকে সাহিত্যে উদ্বুদ্ধ করে।

mohibur_rahim0
তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ সময় থেকে রচিত হয় তার ‘অতিরিক্ত চোখ’, ‘হে অন্ধ তামস’, ‘অনাবাদি কবিতা’, ‘পলি মাটির অন্তর’, ‘দু:খগুলো অনাদির বীজপত্র’, মিলেনিয়াম শব্দজট’, ‘সবুজ শ্যামল মন’, ‘শিমুল রোদে রঙিন দিন’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, ড. রাজিব হুমায়ুন, কবি সমুদ্র গুপ্ত, আশুতোষ ভৌমিক, মানিক মাহমুদ, প্রফেসর ড. কামরুল আহসান, ড. ফজলুল হক সৈকত, মানবর্দ্ধন পাল, তৌফিক জহুর, নাজমা মমতাজ, মিলি চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম জীবন ও ড. ফজলুল হক তুহিনসহ গুরুত্বপূর্ণ লেখক এবং আলোচকগণ মহিবুর রহিমের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। নব্বই দশকের প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্য সংকলনগুলোতে তার লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্প্রতি তার আরও ৩টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘সবুজ শ্যামল মন’, ‘শিমুল রোদে রঙিন দিন’ ও ‘হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই’।

মহিবুর রহিমের কবিতা নিয়ে সাম্প্রতিক কালের বাংলা ভাষার প্রধান কবি আল মাহমুদ লিখেছেন- ‘সাম্প্রতিক সময়ে যে কয়জন কবির কবিতা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মহিবুর রহিম তাদের একজন। কবিতা লেখার জন্য কবিদের স্বতন্ত্র অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন হয়, মহিবুর রহিমের তা রয়েছে। এ জন্য তার কবিতা পাঠক হৃদয়কে স্পর্শ করে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে। বিশেষ করে তার শব্দ ব্যবহারের প্রতি নিষ্ঠা, কল্পনা ও নিজস্ব পদবিন্যাস আমাকে আনন্দিত করেছে। আমার বিশ্বাস, বাংলা সাহিত্যে একদিন সে নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিতে পারবে।’

কবি সমুদ্রগুপ্ত তার কবিতা প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘সাম্প্রতিক কালের কাব্য কাঠামোয় দক্ষ এই কবি কবিতায় চর্চা করেন এক অগ্রগামী ধারণার স্বপ্ন। লক্ষ্যহীন রাজপথ থেকে হঠাৎ নয়ানজুলি খাদ, অনুল্লেখ্য ঘরবাড়ি, শস্যক্ষেত, আলপথ ঘুরপথ ঘাস আর কাদায় পিছলাতে পিছলাতে যে পায়ে চলা পথ চলে গেছে চলে গেছে নদীদের দিকে, যে পথ- পথ হারায় না রাজার পথের মতো, যে পথ প্রতিপথ পাশে না খুঁজতেই পেতে থাকে পথের ঠিকানা। মহিবুর রহিমের কবিতার সিদ্ধান্ত অনেকটাই এ রকম।… তরুণ এই কবি। কবিতা তার মাধ্যম মাত্র। মূলত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর দৃষ্টিভঙ্গিগত গবেষণার মাধ্যমে আমাদের বৃহত্তর জীবনকেই বিশ্লেষণ করেন। কবিতায় সিদ্ধান্ত উচ্চারণের সাহস তার আছে।’
মহিবুর রহিমের কবিতা সম্পর্কে একটি মূল্যবান মন্তব্য করেছেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উপ-পরিচালক মানিক মাহমুদ। তিনি লিখেছেন- ‘কবি মহিবুর রহিমের ভাবনার চোখটা একটু অন্য রকম। একের ভিতর তিনি রহস্য ও সৌন্দর্যকে খুঁজেন। মহিবুর রহিমের লেখায় ধার যেমন আছে তেমনি বিষয়কে দেখবার, গভীরে যাবার সচলবোধ তার ভিতরে কাজ করে। এসব বৈশিষ্ট্যের জন্যে তার কবিতা কাব্যপ্রেমিদের দৃষ্টিসীমায় ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে। পেশাগত কারণে কবি শহরমুখী হলেও তার কবিতায় কাদা মাটি ঘাসের জলো ঘ্রাণ কাজ করে। মহিবুর রহিমের কবিতা পড়লে এক ধরনের মুগ্ধতায় মন ভরে যায়। তার এমন কিছু কবিতা আছে- বার বার পড়েও পড়ার আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে জেগে থাকে।’


কবি ও প্রাবন্ধিক তওফিক জহুর লিখেছেন- ‘একজন কবিকে একা পথ চলতে হয়। চলতে গিয়ে কবি যে কুড়ানো সম্পদ পেয়ে যান, তা দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করে হৃদস্পন্দন। বাংলা সাহিত্যে নব্বই দশক এক বিশেষ ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, একথা আমরা বলতে পারি। নব্বই দশকে যে কয়জন কবি কবিতার মাঝে বেড়ে উঠেছেন মহিবুর রহিম তাদের অন্যতম। কবিতা লেখার জন্য একজন কবির অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। যে চোখ দিয়ে একজন কবি প্রজাপতির ডানায় লিপিবদ্ধ করা অক্ষরগুলো পড়তে পারেন। গাছের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মেঘের ডানায় চেপে উড়তে পারেন অসীমলোকে। ‘অতিরিক্ত চোখ’ পাঠ করে আমাদের মনে হয়েছে মহিবুর রহিম সে দৃষ্টিশক্তি অর্জন করেছেন।’


অধ্যাপক মানবর্দ্ধন পাল তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করে লিখেছেন- ‘অতীন্দ্রিয় তৃতীয় দিয়েই একজন কবি আনুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেন জীবন ও জগত। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের এই পর্যবেক্ষণশীলতায় একজন প্রকৃত সৃষ্টিশীল কবির অনুভব প্রতিভাষিত হয় শব্দশিল্পে। আর কবিতা নামক শব্দশিল্প কেবল অনুভবের কেলাসিত রূপ নয়, তার সঙ্গে মণি-কাঞ্চনের মত যুক্ত থাকে ছন্দ ও বাণীর আলকেমি। যার তৃতীয় নয়ন নেই তিনি আর যা-ই হোন অন্তত কবি নন। এই তৃতীয় নয়নধারী একজন, যার নাম মহিবুর রহিম, কবি এবং আমু-নখাগ্র কবিই তিনি। কবিতাই তার ধ্যান-জ্ঞান, আজন্ম কবিতা অন্তপ্রাণ এবং ফলবান সবুজ মানুষ। একজন কবির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনিবার্যতা, তৃতীয় নয়নের আবশ্যকতা মহিবুর রহিম কবিতা রচনার শৈশবকালে অবিসংবাদিতভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই তার কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছেন ‘অতিরিক্ত চোখ’। কাব্যগ্রন্থের এই শিরোনামই প্রতিপন্ন করে কবি মহিবুর রহিম তৃতীয় নয়নের অনুসন্ধানী কেবল নন; তা তিনি খুঁজেও পেয়েছেন।’ তার কবিতা নিয়ে এমনি অনেক আলোচনা করেছেন বিদগ্ধ জন।

মৌলিক সাহিত্যচর্চা ছাড়াও মহিবুর রহিম লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক সমীক্ষা গ্রন্থমালায়’ তার লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়। জাতীয় লোকসঙ্গীত সম্মেলনে তিনি ন্যাশনাল অর্গানাইজিং কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হন। মহিবুর রহিম কুমিল্লা অঞ্চলের লোকসঙ্গীত, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকসাহিত্য, ভাটি বাংলার লোকসাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা করছেন। বাংলা একাডেমির ‘লোকজসংস্কৃতির বিকাশ কর্মসূচির’ আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকসাহিত্য’ বিষয়ে কাজ করেছেন যা সম্প্রতি ৪৮০ পৃষ্ঠার বই আকারে বাংলা একাডেমি থেকে বের হয়েছে। লোকসাহিত্য গবেষণার জন্যে মহিবুর রহিম ‘প্রজ্ঞা’ শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পদক ও স্মৃতি’৫২ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে ‘রকি সাহিত্য পদক ২০১১’, ‘মেঠোপথ সাহিত্য পদক-২০১৩’, ‘শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহিত্য পদক-২০১৪’ লাভ করেছেন। পেশাগত জীবনে মহিবুর রহিম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ও শিক্ষক পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তথা দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে তিনি একজন সরব ব্যক্তিত্ব। তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম সরকারি চাকুরিরত। তাদের রয়েছে তিন পুত্র সন্তান।

সম্প্রতি তিনি আমাদের নিকলী ডট কমে নিয়মিত লিখতে সম্মত হয়েছেন। এজন্য আমরা কবিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এর ফলে আমাদের নিকলী ডট কমের পাঠকগণ কবির লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় লাভ করতে পারবেন।

 

তোফায়েল আহছান

কো-অর্ডিনেটর, আমাদের নিকলী.কম

Similar Posts

error: Content is protected !!