খোন্দকার মো: মেসবাহুল ইসলাম ।।
সারা বছর সবজি ও ফল হিসেবে পাওয়া যায় এমন একটি ফসল হলো পেঁপে। একই গাছ থেকে অপরিপক্ব ফল বা কাঁচা সবুজ পেঁপে সংগ্রহ করে সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। কাঁচা পেঁপের তরকারি একটি উপাদেয় ও ওষুধি সবজি হিসেবে বাংলাদেশে জনপ্রিয়। অন্য দিকে পরিপক্ব বা পুষ্ট পেঁপে একটি চমৎকার পুষ্টিকর ও জনপ্রিয় ফল।
কথায় আছে- ‘প্রতিদিন পেঁপে খাও, বাড়ির বাইরে ডাক্তার তাড়াও’ অর্থাৎ প্রতিদিন কাঁচা পেঁপের তরকারি বা পাকা পেঁপে খাওয়া শরীরের পে খুবই উপকারী। পুষ্টিগুণের দিক দিয়েও পেঁপে অন্য ফলের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর। পাকা পেঁপে ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ। কাঁচা পেঁপেতেও ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি১ ও ভিটামিন-সি আছে। এ ছাড়া কাঁচা বা পাকা পেঁপেতে লৌহ ও ক্যালসিয়াম আছে। হজমে সহায়ক পেঁপে কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই তাই শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রেখে থাকে। শীতের শেষে ফাল্গুন মাসে পেঁপে চারা রোপণ করা যায়। এ সময়ে রোপণ করা পেঁপের গাছের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এ সময়ে রোপণ করা পেঁপেগাছ লম্বা হয়। এ কারণে ঝোড়ো বাতাসে বা ঝড়ে পেঁপেগাছ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পেঁপেগাছ বড় হলে খুঁটি দিয়ে ঠেস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। পেঁপের চারার বয়স ৩৫-৪০ দিন হলেই রোপণের উপযুক্ত হয়। এ সময় চারার উচ্চতা সাধারণত ১৫ সেন্টিমিটারের মতো হয়। রোপণের জন্য যে স্থান নির্বাচন করা হয়, সে স্থানটি অবশ্যই নিষ্কাশিত হতে হয়; অর্থাৎ কোনোক্রমেই পেঁপের জমিতে যেন পানি জমতে না পারে, সে দিকে ল রেখেই জমি নির্বাচন করতে হয়। জমি তৈরির পর রোপণ দূরত্ব অনুযায়ী সারি বরাবর বেড তৈরি করতে হয়। দুই সারির মাঝের স্থান থেকে এমনভাবে মাটি তুলে নিয়ে দুই পাশে রাখতে হয়, যাতে দুই সারির মধ্যে একটি নালা তৈরি হয় এবং বেডগুলো দুই দিকে নালা বরাবর ঢালু হয়। বেড ঢালু করার কারণ হলো কোনোক্রমেই যেন পানি বেডের ওপর না জমে, দুই দিকের নালায় গড়িয়ে যায়।
দুই থেকে আড়াই মিটার পরপর সারি করে সারিতে একই দূরত্বে ৪৫-৬০ সেন্টিমিটিার চওড়া ও ৪৫-৬০ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত করে রোপণ করতে হয়। গর্তের মাটি ঝুরঝুরে করে মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে দিতে হয়। চারা রোপণের তিন-চার দিন আগে রাসায়নিক সার মিশাতে হয়। প্রতি গর্তে ১৫ কেজি জৈব সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ২৫ গ্রাম বোরিক অ্যাসিড এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট একত্রে ভালোভাবে গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। এরপর প্রতি পেঁপেগাছে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০০ গ্রাম এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। এই পরিমাণ সার চারা লাগানোর পর গাছে নতুন পাতা গজানোর সাথে সাথে প্রতি গাছে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রতি এক মাস পরপর প্রয়োগ করতে হয়। গাছে ফুল এলে এ মাত্রা দ্বিগুণ করতে হয়।
প্রতি গর্তে ২০-২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে দু’টি চারা রোপণ করা যেতে পারে। তবে একটি চারাও রোপণ করা যায়। গাছে ফুল আসার পর পুরুষ গাছ বা স্ত্রী গাছ বোঝা যায় এবং তখন ক্ষেতে শতকরা পাঁচটি পুরুষ গাছ রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলতে হয়। পেঁপে চারা রোপণের দু-তিন দিন আগে গর্তটি সারমিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরাট করতে হয়।
রোপণের আগে পলিব্যাগ থেকে চারা বের করার সময় একটি ব্লেড দিয়ে পলিব্যাগের এক দিক চিরে দিতে হয়। এরপর চারার মাটির বলটি যেন ভেঙে না যায় বা চারার শিকড়ের কোনো রকম তি না হয়, সে দিকে ল রেখে চারাটি গর্তের ভরাট করা মাটিতে হাত দিয়ে চারার মাটির বলের আকারের চেয়ে একটু বড় গর্ত করে সে গর্তে চারাটি স্থাপন করতে হয়। চারার গোড়া পলিব্যাগে যতটুকু বাইরে ছিল, ঠিক ততটুকুই বাইরে বা ওপরে রেখে রোপণ করতে হয়। কখনোই চারার গোড়া বেশি গভীরে পুঁতে দেয়া বা চারার গোড়ায় অতিরিক্ত মাটি দেয়া উচিত নয়। এতে পেঁপে চারা গোড়া পচা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ সময়ে চারার গোড়ায় প্রথম দু-এক দিন কোনো পানি সেচের প্রয়োজন পড়ে না। তবে পাতার ওপরে হালকা করে হাত দিয়ে ছিটিয়ে পানি দেয়া যেতে পারে।
পেঁপেগাছে সাধারণত চার-পাঁচ মাসে ফুল ধরে এবং ছয়-সাত মাসে কাঁচা পেঁপে সংগ্রহ করা যায়। প্রথম দিকে গাছে প্রচুর পেঁপে ধরে। এগুলোর মধ্য থেকে কিছু কিছু ফল ছাঁটাই করতে হয় অর্থাৎ ফল সংগ্রহ করে পাতলা করতে হয়। তাহলে অন্য পেঁপেগুলো যখন পরিপক্ব হয়, তখন বড় আকারের হয়। আর রোপণের ৯-১০ মাস পর পরিপক্ব পেঁপে ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়।
লেখক : উদ্যান বিশেষজ্ঞ